ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণ জরুরী

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২০ নভেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণ জরুরী

একটি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে প্রাচীন পুরাকীর্তি ও প্রত্নসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মসজিদ-মন্দির-প্রাসাদসহ বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন থেকেছে। এটা খুবই পীড়াদায়ক। এই নির্লিপ্ততা চলতে থাকলে অযত্ন -অবহেলা আর দখল-দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে কালের সাক্ষী আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক স্থাপনাগুলো। সাহিত্যস¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্র একদা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন বাঙালীর কোন ইতিহাস নেই। এক্ষেত্রে তিনি নিশ্চয়ই লিখিত ইতিহাসের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে একথাও সত্য যে, বাঙালীর ইতিহাস লেখার জন্য যথোপযুক্ত উপকরণের বড়ই অভাব। এই জল-কাদা, মারী-মড়ক-মন্বন্তরের দেশে ঝড়ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প, বৃষ্টি-বাদল, বন্যা, নদ-নদীর একূল ভাঙ্গা ওকূল গড়ার দেশে ইতিহাসের সপক্ষে পাথুরে প্রমাণ বুঝি বেশিদিন টেকসই হয় না। মহাকালের গহ্বরে প্রায়ই হারিয়ে যায় অথবা চাপা পড়ে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গাগড়ার খেলায়। সময়ের আবর্তে শাসক আসে, শাসক যায়। নতুন শাসক ক্ষমতার মসনদে বসে লিখতে চায় নিজের মনমতো ইতিহাস। পুরনো শাসকদের ছুড়ে ফেলতে চায় আঁস্তাকুড়ে, ভেঙ্গে ফেলে পুরনো পুরাকীর্তি, গড়ে তোলে নিজের স্থাপনা। হায়, সে নিজেও জানে না কালের প্রবাহে একদিন অনিবার্য তাও ধূলিসাত হবে! এর পাশাপাশি আরও একটি কথা বোধ করি প্রণিধানযোগ্য- বাঙালী বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি। ইতিহাসের সবকিছু তারা অতি দ্রুত ভুলে যায়; যার যা প্রাপ্য যতটুকু প্রাপ্য, ততটুকু দিতে কেন যেন বড়ই কৃপণ ও কুণ্ঠিত। অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন সময় নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পুরাকীর্তিগুলো। অথচ যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ইতোমধ্যে আমাদের দেশের অনেক পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। এখনও যেগুলো আছে সেগুলোও বিলীন হওয়ার পথে। তবে আশার কথা হচ্ছে, রাজধানীর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনে কোন স্থাপনা ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ বা সংরক্ষণ বা সংস্কারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় সময়; কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো সময়ের চিহ্নকে জীবন্ত করে রাখে। ঢাকার প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের অনেক বীরত্বগাথা, আত্মত্যাগের ইতিহাস। অথচ দীর্ঘদিনের অযত্ন আর অবহেলার কারণে এসব পুরাকীর্তি কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। আবার বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা বেদখলে চলে গেছে। কিন্তু এসব স্থাপনা-পুরাকীর্তির যথাযথ সংরক্ষণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে তা কেবল ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মারক হয়েই থাকত না, দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নজর কাড়তে পারত। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো আমরাও এসব স্থাপনা ও নিদর্শনকেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারতাম। তবে দেরিতে হলেও রাজধানী ঢাকার ৯৩টি ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। সরকারের এই উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে ঢাকার এসব স্থান-স্থাপনা যেমন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, তেমনি পর্যটক বা দর্শনার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারলে তা থেকে ভাল অঙ্কের রাজস্ব পাওয়া যাবে। সারাদেশের আনাচে-কানাচে যেসব ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পুরাকীর্তি এখনও আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বাঙালীর জীবনে ১৯৭১ একটি ঐতিহাসিক সময়কাল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের ২৪ বছরের শাসন এবং শোষণ থেকে মুক্তি পেতে নিগৃহীত বাঙালী জাতি একাত্তরের মার্চে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্নে। তবে এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। একদিনে বা হঠাৎ করেই বাঙালী জাতি স্বাধীন দেশের স্বপ্নে যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় একীভূত করতে যিনি নিবেদিতপ্রাণ লড়াই করেছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ধাপে ধাপে তিনি বাঙালীকে সংঘবদ্ধ করেছেন। নিজস্ব একটি ভূ-খণ্ডের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। রেসকোর্স ময়দান শুধু একটি স্থান নয়, এটি বাংলা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি অধ্যায়ের নাম। শিশু পার্ককে স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের আওতায় নেয়া মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক সত্য নিয়ে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করা। এই উদ্যোগের ফলে জাতি ইতিহাসের আরেকটি কালিমা থেকে মুক্তি পেল। যত দ্রুত এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডটি তত দ্রুত স্বমহিমায় আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে। কেননা, প্রাচীন স্থাপনাগুলো আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক। আমাদের অতীত গৌরবের সাক্ষী। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। এর জন্য উদ্যোগী হতে হবে সরকারকেই। সারাদেশের গ্রামেগঞ্জে যেসব প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে এগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে ঐতিহ্য নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে সংরক্ষিত বা সংরক্ষণযোগ্য নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত স্থাপনাগুলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অবহেলা-ঔদাসীন্যে ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হওয়া শুধু দুঃখজনকই নয়, জাতি হিসেবে আমাদের জন্য চরম অগৌরবজনকও। কিন্তু গভীর উদ্বেগের বিষয়, আমাদের দেশের অনেক মূল্যবান পুরাকীর্তি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে অন্য দেশে পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশের পুরাকীর্তির পাচার রোধ এবং এগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরকে আরও বেশি সতর্ক এবং মনোযোগী হতে হবে। সেইসঙ্গে পাচার চক্রের পুরো নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে। ঐতিহাসিক স্থাপনার পরিচর্যার পাশাপাশি প্রাপ্ত পুরাকীর্তি সংরক্ষণে উদ্যোগ নিতে হবে। সেসব নিদর্শন থেকে নতুন প্রজন্ম অতীত ইতিহাসকে জানতে পারবে। [email protected]
×