ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রিয়াজুল হক

ছেঁড়া নোট এবং জাল নোট প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৯ নভেম্বর ২০১৭

ছেঁড়া নোট এবং জাল নোট প্রসঙ্গে

পরিচিত একজন বাজার থেকে দুই কেজি মাংস কেনার পর বিক্রেতাকে পাঁচশ’ টাকার দুইটা নোট দিলেন। বিক্রেতা একটি নোট রেখে অন্যটি ফেরত দিয়ে দিলেন। টাকার এক কোনায় সামান্য একটু ছেঁড়া আছে, সেজন্য সেই টাকা পাল্টে দিতে বললেন। তখন সেই প্রতিবেশী মানুষটি পড়লেন মহাবিপদে। পকেটে সেই মুহূর্তে আর তেমন টাকা ছিল না, যা মাংস বিক্রেতাকে দিতে পারেন। দোকানিকে যতই তিনি বোঝাবার চেষ্টা করলেন, এই ছেঁড়ায় কোন সমস্যা হবে না কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। দোকানির সাফ কথা, স্যার এই টাকা কেউ নেবে না। ব্যাংকের ডিপিএস জমা দিতে পারব না। আপনি পাল্টে না দিলে আমার পুরাই ক্ষতি হয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে তিনি দুই কেজির পরিবর্তে এক কেজি মাংস নিয়ে বাড়ি আসলেন। এরপর বিকেলে যখন তার সঙ্গে দেখা হলো, আমাকে সেই পাঁচশ’ টাকা দিয়ে বললেনÑ এটা কি করা যায়? খুব সামান্য একটু ছেঁড়া ছিল। শতকরা দুই ভাগ হবে সম্ভবত। অমি বললাম এই টাকায় সমস্যা নেই, চলবে। যে কোন ব্যাংকের শাখায় নিয়ে গেলে পাল্টে দেবে। তখন তিনি খুলে বললেন। আমরা হয়ত অনেকেই জানি না একটা নোট কতটুকু ছেঁড়া-ফাটা থাকলে তার মূল্যমানে কোন সমস্যা হয় না। যদি নিজের কাছে রাখলে মনে হয় সেই নোটের কোন বিনিময় মূল্য পাওয়া যাবে না, তবে যে কোন ব্যাংকের শাখা থেকে টাকা পরিবর্তন করে নিতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক (নোট রিফান্ড) রেগুলেশন্স এ্যাক্ট-২০১২ এর আলোকে ছেঁড়া-ফাটা নোট ব্যাংক শাখায় গ্রহণ এবং উহার বিনিময় মূল্য প্রদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪-০১-২০১৩ তারিখ একটি পরিপত্র জারি করে। এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তা মূলত দুইটি বিষয় নিশ্চিত হয়ে অল্প ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লা নোটের বিপরীতে সম্পূর্ণ বিনিময় মূল্য প্রদান করে থাকবেন। (ক) উপস্থাপিত নোটটিতে সম্পূর্ণ নোটের ৯০% এর বেশি অংশ বিদ্যমান থাকবে এবং আসল নোট হিসেবে শনাক্ত হতে হবে। (খ) উপস্থাপিত নোট একাধিক খ-ে খ-িত নয় এবং খ- দুইটি একই নোটের অংশ হতে হবে। খ-িত নোটের ক্ষেত্রে নোটের একদিকে হালকা সরু কাগজ দিয়ে এমনভাবে জোড়া লাগাতে হবে, যেন আসল নোট সহজেই বোঝা যায়। দুই খ-ে বিচ্ছিন্ন হয়নি, কিন্তু সামান্য নাড়াচাড়ায় নোটটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এমন জীর্ণ নোটের ক্ষেত্রেও এক পিঠে হালকা সরু কাগজ লাগাতে হবে, যেন নোটটি পরীক্ষা করতে কোন অসুবিধা না হয়। অনেক সময় নোটের অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে থাকে, অর্থাৎ অত্যধিক জীর্ণ, আগুনে পোড়া, ড্যাম্প বা সম্পূর্ণ নোটের ৯০ ভাগ বা তার চেয়ে কম থাকলে, নোট গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তার মূল্য প্রদান করা হয় না। এক্ষেত্রে, নোটের মূল্যমান, সিরিজ নম্বর, জমাদানকারীর নাম ও পূর্ণ ঠিকানা সংবলিত আবেদনপত্রের সঙ্গে ব্যাংক নোটটি গ্রহণ করবে। জমাদানকারীর আবেদনপত্রসহ গৃহীত নোট শাখার ফরওয়ার্ডিং পত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত পরিপত্রের বিধি মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকটস্থ শাখায় নোটটি প্রেরণ করবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নোটটি পাবার আট সপ্তাহের মধ্যে নোট রিফান্ড রেগুলেশন্সের আওতায় নোটটির মূল্য প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে এবং মূল্য প্রদানযোগ্য হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসাবে প্রদান করবে। টাকায় কোন সমস্যা মনে হলে অবশ্যই নিকটস্থ যে কোন ব্যাংকের শাখায় যোগাযোগ করা প্রয়োজন। অনেকেই অজ্ঞতাবশত সামান্য ছেঁড়া-ফাটা বা ময়লা নোট চলবে কিনা, এই সন্দেহে কষ্টে উপার্জিত টাকা বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগী দালালের নিকট কম মূল্যে বিক্রি করে দেয়। অথচ বিভিন্ন দুষ্ট চক্র থেকে পরিত্রাণ পেতে একটু কষ্ট করে ব্যাংকে গেলে, বিনিময়মূল্য হিসেবে পুরো টাকা বা যথাযথ পরিমাণ টাকা ফেরত পেতে পারত। জাল নোটের সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর। কারণ এগুলো পরিবর্তন করার কোন সুযোগ নেই। বরং হাতে থাকলেও বিপদ। জাল টাকা যেহেতু ছড়িয়ে রয়েছে, তাই আমাদের জানা উচিত আসল টাকার কিছু বৈশিষ্ট্য। অন্যথায় কষ্টের উপার্জিত টাকা কখন যে জাল টাকায় রূপ নেবে, তা আদৌ বলা যায় না। সাধারণ মানুষের কিছুটা সচেতনতার অভাব এবং জাল নোট কারবারিদের নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এই সমস্যা সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছে। প্রত্যেকেরই জানা উচিত আসল নোটের বৈশিষ্ট্যসমূহ। বড় নোটের ক্ষেত্রে জাল করার বিষয় জড়িত থাকে। এজন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ১০০, ৫০০, ১০০০ টাকা মূল্যমানের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংবলিত আসল ব্যাংক নোটের কিছু সহজ বৈশিষ্ট্য, যা খালি চোখে দ্রুত বোঝা যায়, আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন। নোটটি সিনথেটিক ফাইবার মিশ্রিত অধিক টেকসই কাগজে মুদ্রিত হবে। নোটের ডানদিকে আড়াআড়িভাবে ইন্টাগিও কালিতে ৭টি সমান্তরাল লাইন আছে। নোটের সামনের দিকে ইন্টাগিও কালিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি মুদ্রিত আছে। ১০০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৫টি ছোট বিন্দু; ৫০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৪টি ছোট বিন্দু এবং ১০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৩টি ছোট বিন্দু রয়েছে যা হাতের স্পর্শে উঁচু নিচু অনুভূত হবে। নোটের বাম পাশে ৪ মিলিমিটার চওড়া নিরাপত্তা সুতা; যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো ও ১০০, ৫০০, ১০০০ টাকা লেখা আছে; সরাসরি দেখলে লোগো ও ১০০, ৫০০, ১০০০ টাকা সাদা দেখাবে; কিন্তু পাশ থেকে দেখলে বা ৯০ ডিগ্রীতে নোটটি ঘোরালে তা কালো দেখাবে। কাগজে জলছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি; প্রতিকৃতির নিচে অতি উজ্জ্বল ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপে ১০০, ৫০০, ১০০০ লেখা আছে এবং জলছাপের বামপাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের উজ্জ্বলতর ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপ রয়েছে। ১০০, ৫০০, ১০০০ টাকার নোটের সামনের দিকে পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা অফসেটে জাতীয় স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ১০০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগিও কালিতে জাতীয় সংসদ ভবন মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ৫০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগিও কালিতে বাংলাদেশের কৃষি কাজের দৃশ্য মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ১০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগিও কালিতে ঢাকার তারা মসজিদ মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ১০০, ১০০০ টাকার ডানদিকের কোণায় ১০০, ১০০০ লেখাটি সরাসরি তাকালে সোনালি এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে। ৫০০ টাকার ডানদিকের কোণায় সরাসরি তাকালে ৫০০ লেখাটি লালচে এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে। কারও কাছে ছেঁড়া নোট থাকলে অবশ্যই নিকটস্থ ব্যাংকের শাখা থেকে পরিবর্তন করে নেয়ার সুযোগ আছে। আমাদের অনেকেই ছেঁড়া নোটের বিনিময় হার সম্পর্কে সচেতন নয়। এই সুযোগে বাট্টায় টাকা বিনিময় কর্মকা-ে জড়িত দালাল শ্রেণী ফায়দা লুটে নিচ্ছে। ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ, যারা সচেতনতার অভাবে নিজেদের প্রাপ্য অর্থ পেতেও বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু এখন সবখানে ব্যাংকের শাখা রয়েছে। আমরা অবশ্যই সেই সুযোগ নেব। জাল নোটের ব্যাপারেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে। কেউ যেন আমাদের অজ্ঞতা কিংবা তাড়াহুড়োর সুযোগ নিয়ে জাল নোট চালিয়ে দিতে না পারে সে বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ দিন শেষে ক্ষতি আমাদের আর অসাধু জাল নোট কারবারিরা লাভবান হবে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, জাল নোট তৈরি করা কিংবা জাল নোট লেনদেন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর সঙ্গে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
×