ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন মাসে ধরা পড়েছে এক মণ সোনা ॥ শাহজালালে চোরাচালান ঠেকানো যাচ্ছে না যে কারণে-

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৯ নভেম্বর ২০১৭

তিন মাসে ধরা পড়েছে এক মণ সোনা ॥ শাহজালালে চোরাচালান ঠেকানো যাচ্ছে না যে কারণে-

আজাদ সুলায়মান ॥ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পর্যাপ্তসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী থাকা সত্ত্বেও ঠেকানো যাচ্ছে না চোরাচালান। প্রতিদিনই আসছে সোনার চালান। আগে আসত বড় চালান। এখন আসছে খুচরা চালান। বিমানবন্দরের বাঘা বাঘা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, প্রতিদিন যে পরিমাণ সোনা আসছে, ধরা পড়ছে তার এক-চতুর্থাংশ। শুধু শুল্ক গোয়েন্দার অভিযানেই তিন মাসেই প্রায় এক মণ সোনা ধরা পড়েছে। শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, সোনা চোরাচালানের বড় সিন্ডিকেট গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন যেভাবে আসছে, ধরাও পড়ছে সেভাবে। যেমন সাধারণ যাত্রীদের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এ সিন্ডিকেট। খুচরা চালানে যে পরিমাণ সোনা গত দুই মাসে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় যদি পাচার হয়েও থাকে তাহলেও সেটা কিন্তু কম নয়। এভাবে যদি সোনা আসতেই থাকে তাহলে এক মাসেই বড় এক চালানের সমান হয়ে যায়। আর খুচরা চালানের বিষয়টি মিডিয়ায় তেমন গুরুত্ব পায় না। এতে শুল্ক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের মাঝেও বিষয়টি তত সিরিয়াস হিসেবে গণ্য হয় না। শাহজালালে এত নিরাপত্তার মাঝেও কিভাবে অনায়াসে সোনা পাচার হচ্ছে- জানতে চাইলে ড. মইনুল খান বলেন, এটাই তো উদ্বেগের বিষয়। এখন দু’ভাবে চোরাচালান হচ্ছে। প্রথমত উড়োজাহাজের ভেতরে সোনা রেখে আসে। পরে গিয়ে নিরাপদ সময়ে সেটা খালাস করে। এ কায়দায় সোনা পাচার করতে গিয়ে গত মাসে ধরা পড়েছে বিমানের নিরাপত্তাকর্মী জাকারিয়া। পরে এয়ারপোর্টে তার রুম থেকেও পাওয়া গেছে সোনার চালান। জাকারিয়া জানিয়েছে কিভাব বিমানবন্দরের লোকজন সোনা পাচারে জড়িত। দ্বিতীয়ত প্রবাসী শ্রমিকরা দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরার সময় দু’-চারটি সোনার বার নিয়ে আসে। তারাও তো ধরা পড়ছে। তিনি বলেন, সোনার চালানে যদি বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী, সিভিল এভিয়েশন ও এয়ারলাইন্সের লোকজন সহযোগিতা করতে পারে লোভে, তাহলে তো তারা বড় ধরনের নাশকতাও করতে পারে। এ উদ্বেগের কথা জানিয়ে ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতর ও সিআইডিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা দফতর থেকে, যাতে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেছেন, বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরের কর্মরত সবগুলো গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করতে হবে। গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এই চোরাকারবারিতে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তবেই চোরাচালান ঠেকানো যাবে বলে আমি মনে করি। পুলিশ জানিয়েছে, চোরাচালানের কৌশল বদলে গেছে। গত তিন বছরে অন্তত চারজন বড় গডফাদার ধরা পড়ায় গুঁড়িয়ে গেছে ওদের ব্যবসা। এদের তিনজন এখন জামিনে বেরিয়ে দেশের বাইরে বসে চোরচালান করছে। পরিবর্তিত কৌশলের মধ্যে তারা বড় চালানের পরিবর্তে ছোট ছোট চালানের মাধ্যমে সোনা পাঠাচ্ছে। এসব চালানের ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকরা, যারা না জেনে না বুঝে এ অপকর্মে জড়িত হচ্ছে। কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, আট-দশ বছর থাকার পর একজন প্রবাসী শ্রমিক যখন দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেন, তখন তার কাছেই ৫-৬টি সোনার বার ধরিয়ে দেয়া হয়। বিনিময়ে তাকে দেশে ফেরার একটি টিকেট ধরিয়ে দেয়া হয়। তাতেই খুশি হয়ে তিনি ওই পরিমাণ সোনার বার হ্যান্ডব্যাগেজে করেই অনায়াসে নিয়ে আসতে পারেন। এ ধরনের যাত্রীদের শতভাগ তো ঢালাওভাবে কাস্টমস হলে বা গ্রীন চ্যানেলে তল্লাশি করা সম্ভব নয়। সন্দেহ হলেও সেটা করার সুযোগ থাকে না। কেন সম্ভব নয়- জানতে চাইলে ড. মইনুল খান বলেন, কাস্টমস ব্যাগেজ রুলে আন্তর্জাতিক যাত্রীদের শতভাগ চেক বা তল্লাশি করার কোন সুযোগ বা উপায় নেই। আইনও সেটা পারমিট করে না। শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ করা যায়। সেক্ষেত্রে শাহজালাল বিমানবন্দরে এর চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক যাত্রীর লাগেজ-ব্যাগেজ চেক বা স্ক্যান করা হচ্ছে। তার মধ্যেও দেখা গেছে সবার লাগেজে সোনা পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে একজনের কাছেও পাওয়া যায় না। কিন্তু তারপরও তো ধরা পড়ছে। তিনি বলেন, ঢাকায় কিছুসংখ্যক পেশাদার লাগেজ ব্যবসায়ী আছে যাদের কাজই হচ্ছে প্রতি মাসে দু’-একবার বিদেশ যাওয়া, বিভিন্ন ধরনের মালামাল এনে লোকাল মার্কেটে বিক্রি করা। তারাই মূলত এখন লাগেজ ব্যবসার আড়ালে সোনা পাচারে জড়িত। যেমন সম্প্রতি এমন একজন যাত্রীকে আটক করা হয়েছে, তার পাসপোর্ট চেক করে দেখা যায় তিনি গত এক বছরেই ৫০ বার বিদেশে যাতায়াত করেছেন। এই পাসর্পোটধারীকে আর জিজ্ঞাসাবাদ বা তদন্তের প্রয়োজন পড়ে না। তিনি যে পেশাদার স্মাগলার তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ রকম অন্তত ৪০ জন লাগেজ ব্যবসায়ীই এখন শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে নিয়মিত সোনা আনছেন। তারা প্রায়ই ধরা পড়েন আবার ছাড়াও পেয়ে যাচ্ছেন। এয়ারপোর্ট থানার ওসি নুরে আজম মিয়া জানিয়েছেন, ছোট ছোট চালান নিয়ে যারা ধরা পড়ছে তারা আইন, থানা পুলিশ, জেলহাজতের প্রতি এত ভীতসন্ত্রস্ত নয়। কারণ ওরা জানে ধরা পড়লে দু’-এক রাত থানায়, কয়েক রাত জেলহাজতে। তারপরই জামিনে মুক্তি। এ কারণেই এ জাতীয় সমস্যা মোকাবেলা বা ভোগ করা তাদের জন্য সহনীয় হয়ে গেছে। ফলে চোরাচালানে বেপরোয়া হয়ে গেছে। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গত এক মাসে যে কটা সোনার চালান ধরা পড়েছে সেগুলোর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে চোরচালান যে বেপরোয়া আকার ধারণ করেছে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সর্বশেষ গত সপ্তাহে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিমান অফিস থেকে পৌনে দুই কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। আন্তর্জাতিক ভবনের চারতলায় বিমানের নিরাপত্তা বিভাগের একটি রুম থেকে পৌনে দুই কেজি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। বিমানের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ওই সোনা উদ্ধার করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। অথচ ওই জায়গাটি কঠোর নিরাপত্তাবলয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে। সরেজমিন দেখা যায়, বিমানবন্দরের চারতলায় রয়েছে পরিচালক শাহজালাল, উপ-পরিচালক, প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা, বিমানের কাস্টমার সার্ভিসের মহাব্যবস্থাপক, বিমানের নিরাপত্তা, অপারেশন ও সিভিল এভিয়েশনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদের অফিস। এসব অফিসে নিয়মিত পদধারীরা বসেন। যেই রুমটি থেকে সোনা উদ্ধার করা হয়েছে সেটি বিমানের এয়ারপোর্ট নিরাপত্তা বিভাগের এক ম্যানেজারের রুম। এখানে এসএম রেজা নামের সিকিউরিটি বিভাগের ম্যানেজার বসতেন। সম্প্রতি জাকারিয়া জাকির নামের বিমানের এক সিকিউরিটি এ্যাসিস্ট্যান্ট সোনাসহ ধরা পড়ার পর থেকেই রুমটি বন্ধ করে রাখা হয়। তারপর সেটা খোলার দরকার দেখা দেয়ায় কাস্টমসকে ডাকা হয়। তাদের উপস্থিতিতেই ওই রুমে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় এ সব সোনা। কাস্টমস জানিয়েছে, বিমানের নিরাপত্তাকর্মী জাকারিয়া সম্প্রতি সোনাসহ আটকের পর থেকেই ওই রুমের ওপর নজরদারি রাখা হচ্ছিল। কারা ওই রুমে যেতেন, কারা বসতেন, কারা সেখান থেকে সোনা পাচার করতেন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতে নিয়েই বিমানকে অবহিত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এ অভিযান চালিয়ে সোনার চালানটি উদ্ধার করা হয়। ওই রুমের ভেতর রাখা একটি কম্পিউটারের পেছনে কয়েকটি বার এবং অন্য টেবিলের ওপর রাখা পেপারের নিচে কয়েকটি বার রাখা ছিল। এমনভাবে সাদামাটা করে রাখা হয়েছিল যাতে কারোর মনে কোন সন্দেহ না হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত কঠোর নিরাপত্তাবলয়ের মাঝে যদি সোনার চালান সহজেই লুকানো যায় তাহলে নিরাপত্তার আর থাকেটা কী? একই মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের চৌকস কর্মকর্তা সদ্য এডিশনাল ডিআইজি পদোন্নতি পাওয়া শেখ নাজমুল আলম। তিনি বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এত নিরাপত্তাবেষ্টনী পেরিয়ে বাইরে এসে ধরা পড়ছে সোনা পাচারকারীরা। সম্প্রতি ডিবি পুলিশের অভিযানে বিমানবন্দরের বাইরে দুটি চালান ধরা পড়ে। তাদের একজন বিমানের কর্মী, একজন সিভিল এভিয়েশনের কর্মী, আরেকজন পেশাদার চোরাচালানি। বাইরে এদের সোনাসহ আটকের ঘটনায় তো এটাই নির্দেশিত হয়, বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় কতটা ফাঁকফোকর রয়েছে। আমরা আপাতত দুটি মামলা তদন্ত করছি। গ্রেফতারকৃত দুজনের কাছ থেকেই যেসব তথ্য মিলেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এতটুকু বলতে পারি, সিভিল এভিয়েশন ও বিমানের কর্মীদের যোগসাজশেই সোনা পাচার হচ্ছে। তাদের নির্বিঘেœ সোনা নিয়ে বাইরে আসার ক্ষেত্রে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে নিম্ন শ্রেণীর কর্মীদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। এদের গডফাদার কারা সেটাও বের করা হবে। গোয়েন্দা পুলিশ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে গত মঙ্গলবার একজনকে সোনাসহ আটক করে। তার নাম ইকবাল হোসেন চৌধুরী। গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (উত্তর) বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল টিম ১২টি সোনার বারসহ তাকে আটক করে। এ সময় চোরাই কাজে ব্যবহৃত একটি ট্র্যাক্সিক্যাবও জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত ইকবাল হোসেন চৌধুরী জানায়, সে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ থেকে তাদের চোরাচালান চক্রের অন্য সদস্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে সোনা পাচারে জড়িত। তারা বিদেশ থেকে চোরাই পথে এসব সোনা নিয়ে আসে। গত মঙ্গলবার বিকেলে ইকবাল বিমানবন্দর থানার গোলচত্বর পুলিশ বক্সের সামনে অবস্থান করছিল। এমন সময় গোপন সংবাদের মাধ্যমে টিম ইনচার্জ জানতে পেরে সেখানে হানা দেন। এ সময় তাকে হাতেনাতে ধরা হয়। তখন ইকবাল খিলক্ষেতের দিকে যাচ্ছিল। ঢাকা মেট্রো-প-১১-৫৭৫৭ নম্বরের একটি ট্যাক্সি যোগে কাওলার মোড়ে পৌঁছার পরই তাকে আটক করা হয়। তার দেহ তল্লাশির সময় সে কালো রঙের ফুলপ্যান্টের ডান পকেট হতে নিজ হাতে ৬টি সোনার বার বের করে দেয়। আসামিকে জিজ্ঞাসা করলে সে আরও তিন-চার জনের নাম প্রকাশ করে, যারা স্বর্ণের বারের মালিক। এর আগে জাকারিয়া নামের বিমানের এক কর্মীকে গোয়েন্দা পুলিশ সোনাসহ আটক করে শাহজালাল বিমাবন্দরের বাইরে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার একপর্যায়ে স্বীকার করে, সিভিল এভিয়েশন, বিমান, কাস্টমস, আনসার, পুলিশ, এভসেক ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করেই এখন চোরাচালান হচ্ছে। এদের সহযোগিতায় যারা চোরচালান করছে তারা পেশাদার। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়েও কিছুসংখ্যক যাত্রী সোনা আনছে, যারা প্রবাসী হিসেবে প্রথমবারের মতো দেশে আসছে। এরা সামান্য কিছু পয়সার লোভে ২-৪টি সোনার বার আনে। তাদের বেশিরভাগই নির্বিঘেœ বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়। এসব বিষয়ে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক রাশিদুল ইসলাম খান বলেছেন, কাস্টমস, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেই তো ধরা পড়ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিছু ফাঁকফোকর আছে কি নেই সেটার তো কোন দালিলিক প্রমাণাদি নেই। তবে দুনিয়ার সব এয়ারপোর্টেই অপরাধীরা তাদের স্বার্থ হাসিলে তৎপর থাকে। শাহজালালও তার ব্যতিক্রম নয়।
×