ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গণশুনানিতে ভয়ঙ্কর বর্ণনা

ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার অভিবাসী নারী শ্রমিক

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১৯ নভেম্বর ২০১৭

ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার অভিবাসী নারী শ্রমিক

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ একটি হাসপাতালে কাজ করতেন ময়না। সেখানে পরিচিত হওয়া এক ব্যক্তির প্ররোচনায় মাসে ত্রিশ হাজার টাকা বেতনের আশায় বিদেশে নারী শ্রমিক হিসেবে পাড়ি জমান তিনি। একদিন ঠিক স্বপ্নের মতোই বিমানে উঠে পাড়ি দেন সুদূর লেবাননে। এরপর কি হলো ? ময়না জানান, ‘বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্রই তাকে নেয়ার জন্য একটি গাড়ি উপস্থিত ছিল। গাড়িতে বসা মাত্রই সেখানে আরেক জন নারীকে দেখতে পান ময়না। গাড়িতে বসা তিন জন পুরুষ আমাদেরকে দেখছিল আর হাসছিল ও মজা করছিল। আমরা দু’জনেই ভয় পেয়ে যাই কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি পরের দিনগুলোতে কি কি ঘটতে যাচ্ছে। পরের দিন আমাদেরকে একটি বাড়িতে নেয়া হয়। দেয়া হয় অনেক ছোট ছোট পোশাক। এরপরই ঘরে প্রবেশ করে দুই লোক। তারা আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এরপর আরও একজন আসে। সে আমাকে বলে আমি তোমাকে চার লাখ টাকা দিয়ে কিনেছি। আমি যা বলব তুমি তাই করতে বাধ্য। যদি কাউকে জানানোর চেষ্টা কর তবে পুলিশের কাছে তোমাকে চোর সাব্যস্ত করে ধরিয়ে দিব। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচজন আমাকে নির্যাতন করত।’ পরবর্তীতে ময়না সেখানে ১১ মাস থাকার পর অনেক কষ্টে নির্যাতিত জীবন থেকে মুক্তি পায়।’ দারিদ্র্য থেকে ন্যূনতম মুক্তির জন্য প্রতিবছর বহুসংখ্যক নারী শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন কাজ করতে। কোথায় যাচ্ছেন, কী কাজ, ভিনদেশী ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন কোন তথ্য না জেনে এবং নাম মাত্র প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা যাত্রা শুরু করেন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত গন্তব্যে। প্রায়ই এসব নারী শ্রমিকদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে এবারই প্রথমবারের মতো শনিবার বেলা আড়াইটায় একটি গণশুনানির আয়োজন করা হয় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। যেখানে বিদেশ থেকে ফেরত আসা নারী শ্রমিকরা বলেন তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা। গণশুনানিতে বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি (অব.) নাজমুন আরা, বিচারপতি (অব.) নিজামুল হক এবং শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক ড. হামিদা হোসেন। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং বাংলাদেশ। এতে সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর। আরেক নারী শ্রমিক হালিমা খাতুন গিয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়া। প্রথম ভাষাগত সমস্যার কারণে খুবই বিপদে পড়তে হয় বলে তাকে জানান হালিমা। আমি তাদের ভাষা বুঝতাম না। অনেক সময় আমাকে মারধর করত। আমি ফিরে আসার কথা বললে আমাকে বলত চার লাখ টাকা দিতে হবে। ২ মাস পর আমি এক ভাইয়ের মাধ্যমে আমার বাড়িতে ফোন করার সুযোগ পাই। আমি তাদেরকে বলি আড়াই লাখ টাকা নেই। এরপর সেখানে চিকিৎসা করায়। কারণ আমার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে অনেক নারীদেরকেই এভাবে আটকে রেখে মারধর করা হত। প্রায় ১০০ নারী ছিল সেখানে। তারা সবাই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল। আমার হার্টে সমস্যা হয়ে গিয়েছিল এমনকি কিডনিও প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে বাড়িতে ফোন করে সবাইকে অনুরোধ করার পর আমার স্বামী ১ লাখ টাকা যোগাড় করে সেখানে দেয়ার পর তারা মাকে ছেড়ে দেয়। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে হালিমা। রোকসানা আক্তার গিয়েছিলেন জর্ডানে। অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানালেন তিনি। বললেন, ‘আমি সেখানে দেড় বছর ছিলাম। গলা টিপে ধরত। শারীরিকভাবে অনেক নির্যাতন করেছে। শুধু আমিই নয়, সেখানে আরও নারীদেরকে আটকে রেখে অত্যাচার করা হত। সবার কাছ থেকেই ৪ লাখ অথবা ৫ লাখ টাকা নিয়ে ফেরত পাঠাতো বাংলাদেশে। আমি এভাবে দেশে ফিরেছি নিঃস্ব হয়ে। জর্ডানে নারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন রওশানারার মেয়ে মনিরা। যাওয়ার দু’মাস পর তাকে জানানো হয় তার মেয়ে একটি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এরপর তার লাশ দেশে পাঠানো হয়। কি কারণে বা কিভাবে তার মেয়ে মারা গেছে তা এখনও জানেন না রওশন আরা। মনিরার মেয়ের বয়স এখন আট বছর। মাতৃহারা মেয়েটির ভবিষ্যত এখন অন্ধকার বলে জানান রওশন আরা। এভাবে অভিবাসী নারীরা তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং কর্মসূচী থাকা সত্ত্বেও অভিবাসী নারী শ্রমিকদের নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সময়ের সঙ্গে নারীদের জন্য বিদেশে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সম্ভাবনা যেমন তৈরি হচ্ছে তেমনি দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। গৃহপরিচারিকা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত নারী কর্মীদের মধ্যে অনেকেই নিয়োগকর্তার অত্যাচারের শিকার। এসব নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা নেয়ার আশ্বাসও দেন কর্র্তৃপক্ষ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কতটা বাস্তবায়ন হয় তা বলাই বাহুল্য বলে জানান আয়োজকরা। এ বিষয়ে বিচারপতি (অব.) নাজমুন আরা বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাংলাদেশী নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সব সময় প্রশ্নের সম্মুখীন। দীর্ঘ সময় জোর করে কাজ করানো, বেতনাদি নিয়মিত পরিশোধ না করা, অবসর বা ছুটির ব্যবস্থা না থাকা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং ধর্ষণসহ বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন বাংলাদেশী নারীরা। আমাদের কাছে নীতিমালা আছে, কর্মপরিকল্পনা আছে কিন্তু সেগুলো আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। একজন নারী শ্রমিক যখন থেকে সিদ্ধান্ত নেন তিনি দেশের বাইরে যাবেন সেখান থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সঙ্গে পুরুষের পার্থক্য রয়েছে। দেখা যায় অভিবাসন বিষয়ে একজন পুরুষ ও তার পরিবার সবাইকে আনন্দের সঙ্গে সংবাদটি দেন কিন্তু একই কাজে গিয়েও একজন নারী সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তা লুকিয়ে রাখে। কাজেই নারীকে সুরক্ষা দিতে সম্মিলিতভাবে প্রবাসী কল্যাণ, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সকলকে কাজ করতে হবে।’ ‘আমাদের এ্যাম্বাসিগুলোও বিভিন্নভাবে দুর্নীতির শিকার বলে মন্তব্য করে এ বিচারপতি। তিনি বলেন, সরকারেরর উচিত সকল সরকারী ও বেসরকারী রিক্রুটিং এ্যাজেন্সি মনিটর করা। অনেকেই আদালতে আসেন না। যদি তারা আদালতে আসেন তাহলে আমরা অনেকভাবেই তাদের সাহায্য করতে পারি। বিভিন্ন এনজিওগুলোকে নারীদেরকে বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে ভালভাবে জানানোর উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান নাজমুন আরা। শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক ড. হামিদা হোসেন অভিবাসী নারীদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে বলেন, ‘এই মানবপাচার রোধ, শ্রমিক নিরাপত্তা, নারী নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ সার্বিক মানবিক অধিকার নিশ্চিতে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা চাই আমাদের কর্মক্ষম নারী শ্রমিকেরা নিরাপদ উপায়ে ও ন্যায্য খরচে বিদেশে যাবেন। তবে যেটি সর্বাগ্রে খেয়াল করতে হবে তা হল, সঠিক নিয়মে নারীদের বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বিশেষ করে যে মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছেন তারা, সেটি বিশ্বস্ত ও সরকারী তালিকাভুক্ত কিনা দেখা দরকার। অপরিচিত মাধ্যমে বিদেশে গেলে পাচারের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। পাশাপাশি, সব কর্মীর জরুরী প্রয়োজনে সাড়া দিতে এজেন্সি, লেবার উইংস ও দূতাবাসগুলোর আরও আন্তরিক হয়ে সেবা দিতে হবে। নির্যাতনের ঘটনা যেসব দেশে বেশি, সেসব দেশের দূতাবাসে নারী কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত শেল্টার হোমের ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রয়োজনবোধে সে দেশের সরকার, শ্রম মন্ত্রণালয় ও নিয়োগকর্তাদের নালিশ করে সমস্যার সুরাহা করতে হবে। এছাড়া নতুন করে বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে চাইলে বিরাজমান অনিয়মগুলো আমলে নিয়ে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে যাচাই বাছাই করে চুক্তিতে সই করা উচিত।’
×