ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার হোক ইতিবাচক

প্রকাশিত: ০৩:০০, ১৯ নভেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার হোক ইতিবাচক

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ তার নিজ প্রয়োজনেই সমাজবদ্ধ হয়ে চলে। সমাজবদ্ধ হয়ে চলতে গেলে আমাদের একে ওপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। যুগে যুগে মানুষ যোগাযোগের জন্য নানা মাধ্যম ব্যবহার করে এসেছে। আমরা সকলেই জানি সময় আমাদের জন্য কতটা মূল্যবান। মানুষ সব সময়ই চেয়েছে যোগাযোগের মাধ্যম যেন সহজ ও দ্রুত হয়। আমরা যে যুগে বাস করি এখন আমাদের কারও চিঠি পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না। গত দশ-পনেরো বছরে যোগাযোগ যতটা সহজ হয়েছে ততটাই দ্রুত হয়েছে। একযুগ আগে যোগাযোগ নিয়ে মানুষ যতটা ভাবেনি তার চেয়ে অনেক বেশি পালটে গেছে এই প্রযুক্তির দুনিয়া। যেখানে একটা মোবাইল ফোন শুধু দূরালাপনের জন্য ভাবা হয়েছিল সেই মোবাইলের হাজারটা সুবিধা তার মধ্যে যোগ হয়েছে বর্তমানে। আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবে আমরা বাস্তব আর ভার্চুয়াল জীবন নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলতে আমরা ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদিকেই বুঝি। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা প্রায় সকলেই প্রচুর সময় ব্যয় করি। বিশেষ করে যাদের কাছে রয়েছে আধুনিক সময়ের স্মার্টফোন অথবা অন্য ডিভাইস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জগতে সামাজিকতা রক্ষার ব্যাপারে আমরা কতটা সচেতন সে বিষয়টাও প্রশ্নের সম্মুখীন। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের অমূল্য সময়। যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা সময় দিচ্ছি তাতে সবাই কতটা সামাজিক হতে পারছি সেটা প্রশ্ন হিসেবে আসতেই পারে। আমরা কি সমাজবদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শিখছি? দ্রুত বদলে যাওয়া এই পৃথিবীতে হঠাৎ পাওয়া কিছু মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। তারা এমন কিছু কাজ করে যেটা অসামাজিক বলেই গণ্য হয়। যখন পৃথিবীতে কোন কিছুর পরিবর্তন হয় সেটা মানুষের প্রয়োজনেই হয় এবং সকলের সুবিধার জন্যই হয়। কিন্তু আমরা দেখি, সুফলের আকাক্সক্ষা করে অনেক বিষয়ই নেতিবাচক ফল দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও অনেকক্ষেত্রে তেমন হয়েছে। আমরা দেখছি ফেসবুকে অনেকে মায়ের অসুস্থতা নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছে আর সেখান থেকে লাইক কমেন্ট নিচ্ছে। কিন্তু মায়ের পাশে থাকছে না। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অনেকে আত্মহত্যাও করছে, যা পরবর্তীতে অন্যকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিতে পারে। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য হেন কিছু নেই যে, কেউ করছে না। ফেসবুকে প্রেমের সম্পর্ক, প্রতারণা এসব বিষয় এখন পুরনো হলেও বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ আসছে প্রতিনিয়তই। এছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল বের হচ্ছে। ফাঁদ তৈরি হচ্ছে। সেই ফাঁদে মানুষ জড়াচ্ছে। কোন বিষয়ের যদি মন্দ দিক থাকে তার সঙ্গে ভাল দিকও কিছু না কিছু থাকে। দ্রুত বদলে যাওয়া এই সমাজের মানুষ খেই হারিয়ে ফেললেও কেউ কেউ সঠিক কাজটা করছে। তবে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো ভাল না মন্দ এই প্রশ্নের উত্তর এখনও ঘোলাটে। নানা মানুষের কাছে নানারকম উত্তর। এটা বলা যায় যে, ফেসবুক ভালও না মন্দও না। ভাল আমরা মন্দও আমরা। আবার এটাও বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সামাজিকও না আবার অসামাজিকও না। আমরাই সামাজিক আমরাই অসামাজিক। শুধু শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে দোষ দিয়ে কি লাভ? আমরা অনেকেই এর ভাল ব্যবহার করি, অনেকেই খারাপ করি। আমাদের অনেকের মাঝেই একটা স্বভাব রয়েছে। যেমনÑ কোন কিছু না জেনেশুনে হঠাৎ করেই একটা মন্তব্য করে বসি। আমি অনেককেই বলতে শুনেছি এরকম যে, ‘এই ফেসবুকটাই পোলাপাইনগো খাইলো’। এই প্লাটফর্মে কত ভাল কাজ হচ্ছে। মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসছে কত তরুণ। সহজেই মিলে যাচ্ছে মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্ত। কত উদ্যোক্তা এখানে তার ব্যবসা পরিচালনা করছে। দলে দলে সৃজনশীল কাজ হচ্ছে। আমি কখনও শুনিনি এ ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলছে। হুট করে একটা বিষয়ের প্রতি বিরূপ মন্তব্য ছুড়ে দেয়া আমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মধ্যে যে অসামাজিক কাজ হচ্ছে সেগুলোই দৃশ্যমান হচ্ছে সবার সামনে। মানুষের কাছে দ্রুত ভাইরাসের মতো ছড়াচ্ছে। অনেকটা সত্যিই আমরা বাস্তব জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, হতাশ হচ্ছি, একাকী অনুভব করছি। বাস্তবের কোন আড্ডায়ও কেউ কারও দিকে নজর দিচ্ছি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ব্যস্ত সময় পার করে যাচ্ছি। এই ভার্চুয়াল জগতে আরও একটা সমস্যা আছে। আমরা যে সমাজে বাস করি সে সমাজে ছোট-বড় সব মানুষেরই আচরণগত একটা গুরুত্ব থাকে। আমরা বরাবরই দেখে আসছি এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আদব-কায়দা থেকে আমাদের বাস্তবের আদব-কায়দার ভিন্নতা রয়েছে। এই বিষয়টাই মাঝে-মধ্যে সমস্যা তৈরি করে। হুট করে মন্তব্য করে বসছি। কিছু না জেনেই হুট করে চটে যাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগের বিষয়গুলোকে নেতিবাচকভাবে যেমন দেখা যায়, তেমনি ইতিবাচকভাবেও দেখা যায়। আমরা দেখেছি মানুষের স্ট্যাটাসের কারণেই অনেক সরকারী সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে। অনেকেই ন্যায়বিচার পেয়েছে এই মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে। আবার এই ভার্চুয়াল সমাজ অনেকক্ষেত্রে উল্টোপথেও হাঁটছে, যা সময় সময় সমাজব্যবস্থায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই অনলাইন সমাজের আরেকটি গুরুতর বিষয় হলো মানহানি। মানহানির বিষয়টা একটা বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বিষয় আমরা গুলিয়ে ফেলেছি। সমালোচনা, মজা করা, কোন কিছুর রিভিউ করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে মন্তব্য করা ইত্যাদি এর মধ্যে সম্পৃক্ত। এখানে মজা করতে গিয়ে কিংবা কারও সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে এমন কিছু ভাষা ব্যবহার আমরা করছি যেটার মাধ্যমে আরেকজনের সম্মানের হানি হতে পারে । এতে করে এই সামাজিক যোগাযোগ যার অনেকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়। আবার অনেককেই দেখেছি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হেয় করতে গিয়ে নিজে সমস্যায় পড়েছেন। আইনী ঝামেলায় পড়েছেন। ধর্মের ব্যাপারে খোলামেলা বলতে গিয়ে জীবন হারিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নিয়ে নেতিবাচক আলোচনাই বেশি হবে। আমরা ঘুরেফিরে যাকে অসামাজিকই বলে দিতে পারি। তবে তার ভাল দিকগুলো ভুলে গেলে চলবে না। সমাজকে আরও সমাজবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবশ্যই ভূমিকা আছে। ভাল দিকগুলো চর্চা করা এবং তা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আরও সুস্থ ধারায় আসতে পারে। সৃজনশীল ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সত্যিকার অর্থেই সার্থক হতে পারে। তাই আসুন আমরা সকলে শুধু ভাল কাজেই প্রযুক্তির কল্যাণের এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করি। যার দ্বারা আমরা নিজেকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি দেশকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। শেষ কথা, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের সামাজিক হতে হবে, অসামাজিক নয়। লেখক : সাংবাদিক
×