ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অতিথি পাখি শিকার

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ১৯ নভেম্বর ২০১৭

অতিথি পাখি শিকার

পাখি হলো প্রকৃতির শিশু। পাখির স্বভাবের অমলিন উচ্ছলতা শিশুর মতোই, তা হৃদয়ে জন্ম দেয় স্নেহবোধের। মনকে দেয় সুন্দরের সাহচর্য। পাখির সৌন্দর্য মানব মনে জাগায় মমতার অনুভব। অথচ হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে যখন কেউ দেখে প্রকৃতির অপরূপ লীলা, তখন অন্য কেউ হয়ত একগুচ্ছ স্বাদু মাংসের ওড়াউড়ি দেখে হয়ে ওঠে লোভী। কবি যেমন লেখেন, বৃক্ষে হাত দিয়ে ব্যবসায়ী দেখে কেবলই কাঠ আর কবি টের পায় প্রাণ। যে কারণে আরেক কবি লেখেন, পাখি হয়ে যায় এই প্রাণ। উষ্ণতার সন্ধানে বাংলাদেশের হাওড়, বিল, জলাশয়ে আশ্রয় নিতে আসা অতিথি পাখিদেরও কাল হয়ে যায় তাদের শরীরের মাংস। এর লোভেই একশ্রেণীর রসনাকাতর মানুষের ভোগের জন্য অতিথি পাখিদের শিকার করে বিক্রি করে দেয়া হয়। এ কেবলই নিষ্ঠুরতাই নয়, বর্বরতারই নামান্তর। আইন কানুন উপেক্ষা করে অতিথি পাখি শিকার চলে আসছে অবাধে। শীতের শুরুতেই এক শ্রেণীর শিকারি তৎপর হয়ে ওঠে। এবারও তাই। এসব শিকারিরা স্থানীয় হাটবাজারে প্রকাশ্যে পাখি বিক্রি করে। প্রতিবারের মতো এবারও শীতের শুরুতে খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে আসতে শুরু করেছে অতিথি বা পরিযায়ী পাখিরা। দেশের বিভিন্ন খাল-বিল জলাশয়ে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু শিকারি ফাঁদ ও জাল দিয়ে পাখি শিকার করে বিক্রি করছেন বিভিন্ন হাটবাজারে। প্রতি জোড়া পাখি পাঁচ শ’ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অতি লাভের আশায় পাখি শিকার ও বেচা-কেনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে এক শ্রেণীর অসাধু লোকজন। শহর ও গ্রামীণ হাটবাজার এমনকি খোদ রাজধানীর সড়কেও বেচা-কেনা হচ্ছে পরিযায়ী এসব পাখি। প্রকৃতির অশেষ দান হচ্ছে পাখি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশও, যা প্রকৃতিপ্রেমীসহ সব মানুষের মনকে দোলা দেয়। যেখানে পাখি বা পাখির গান নেই, সেস্থান অবরুদ্ধ ও বৈচিত্র্যহীন। সেখানকার প্রকৃতি ও নিসর্গে প্রাণ বলতে কিছু নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য। কিছু দুর্বৃত্ত শিকারির ভয়াবহ ছোবল থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না এসব পাখি। পাখি নিধনের কারণে একদিকে নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ফসলি জমিতে বাড়ছে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ। পাখিরা শুধু প্রকৃতির শোভাবর্ধন করে না। ভারসাম্যও রক্ষা করে। পোকামাকড় খেয়ে এরা কৃষকের যথেষ্ট উপকার করে থাকে। পাখির অবাধ বিচরণের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া অত্যন্ত চমৎকার। তাই শীত মৌসুমে প্রতিকূল অবস্থান থেকে আত্মরক্ষার্থে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে দলে দলে পাখি অতিথি হয়ে আগমন করে নদীমাতৃক এই দেশে। এসব পাখি দেশের সুন্দরবন, সুনামগঞ্জের হাওড়, মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা চিড়িয়াখানার জলাশয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বিল ও জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশে ৬৫০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে ৪৫০ প্রজাতি স্থায়ীভাবে বাস করে। বাকিরা অতিথি বা পরিযায়ী পাখি। মানুষের বিরূপ আচরণের শিকার হয়ে সপ্তদশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩০ প্রজাতির পাখি চিরতরে হারিয়ে গেছে। এ ছাড়া বর্তমানে প্রায় ১২ শ’ প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে দন্ডের বিধান থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগ নেই। পাখি শিকারিদের ছোবল-ছাড়াও পাখি হারিয়ে যাওয়ার আরও কারণগুলো হলো জলাশয় ভরাট, অবাধে গাছপালা কাটা, নিম্নভূমিগুলো দখল করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা। পাখির জীবন রক্ষার্থে এসব বন্ধ করা সঙ্গত। সর্বোপরি কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করাও জরুরী। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে পাখির বাসস্থান নিশ্চিত করা এবং অবাধ পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে। বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে পাখি শিকার বন্ধে কার্যকর ভূমিকা দরকার। জনসচেতনতা বাড়ানো না গেলে নিধন যেমন বন্ধ হবে না, তেমনি পরিয়ায়ী পাখিদের আগমনও হ্রাস পাবে। পরিবেশ প্রতিবেশের স্বার্থে এ সংক্রান্ত আইনকে কার্যকর করার বিকল্প নেই।
×