ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

থিয়েটারের ইতিহাস সংরক্ষণ জরুরী ॥ আশীষ গোস্বামী

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১৮ নভেম্বর ২০১৭

থিয়েটারের ইতিহাস সংরক্ষণ জরুরী ॥ আশীষ গোস্বামী

পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত নাট্য গবেষক ও নাট্যকার, আশিষ গোস্বামী। ৩৫ বছর ধরে তিনি দুই বাংলার নাটক নিয়ে গবেষণা করছেন। এ পর্যন্ত ২৫টির বেশি নাটক এবং ১৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ বিভিন্ন বিশ্ববিদালয়ের পাঠসূচী হিসেবে পঠিত হয়ে থাকে। তিনি ১৯৮২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘থিয়েটার এ্যান্ড ফিল্ম ক্রিটিসিজম’ বিষয়ে এমএ এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৯৯ সালে ‘থিয়েটার ক্রিটিসিজম’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। সম্প্রতি তিনি একাধিক সেমিনারে তার গবেষণা পত্র উপস্থাপন এবং একাধিক থিয়েটারকে নিয়ে তার ধারাবাহিক গবেষণা কর্ম তুলে ধরতে ঢাকায় এসেছেন। গবেষণা কর্ম এবং দুই বাংলার নাট্যচর্চা নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। প্রথমেই জানতে চাই আপনার দেখা এই কয়েক যুগে থিয়েটারের পরিবর্তন কি দেখছেন? আশীষ গোস্বামী : থিয়েটারের ল্যাঙ্গুয়েজ ১০-১২ বাদে বাদেই পরিবর্তন হয়। কিন্ত এই পরিবর্তনটাকে থিয়েটারের পপুলার মানুষগুলো ঠিক সেভাবে নিতে পারে না। দুই বাংলাতেই ভাল থিয়েটার হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক কখনও কখনও থিয়েটার বন্ধ্যা দশায় পড়ে। আবার সেই বন্ধ্যা দশা কাটিয়ে ভাল থিয়েটার হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দর্শক থিয়েটার দেখতে খুব কম যায়, দর্শক স্টার দেখতে যায়। দর্শক যদি থিয়েটারকে পৃষ্ঠপোষকতা না করে তাহলে থিয়েটার বাঁচবে কেমন করে। থিয়েটারটা হচ্ছে মাইনোরিটি কালচার। আর সেটা বেঁচে থাকে দর্শকের পৃষ্ঠপোষকতায়। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে দর্শক নানা বিষয়ে এত বেশি এনগেজড হয়ে গেছে, জীবন যাত্রা এমন জটিল হয়ে গেছে, যে থিয়েটারকে পৃষ্ঠপোষকতা করা থেকে দর্শক ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এ কারণে থিয়েটারকে একটু অন্যভাবে বাঁচানোর চেষ্টাটা কীভাবে হতে পারে সেই বিষয় জানতেই আমি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াই। থিয়েটারকে নিয়ে যারা অন্যভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তাদের অনুসন্ধানটা করতেই যাই। থিয়েটার পরিবর্তন হতে হতে এক্সপেনসিভ জায়গায় চলে গেছে। সেটা সবার পক্ষে এফোর্ড করা সম্ভব নয়। তবে আসল কথা হচ্ছে থিয়েটার করে বাঁচতে হবে থিয়েটারকে বাঁচাতে হবে। এটার অল্টারনেট কি হতে পারে সেটাই জানার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশে কি বিকল্প থিয়েটারের সম্ভাবনা আছে? আশীষ গোস্বামী : অবশ্যই আছে। আমি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখেছি অজস্র মানুষ, একেবারে ইয়াং জেনারেশন, তরুণরা তারা নানাভাবে থিয়েটারকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তাদের ধরনটা একেবারে স্যালুট করার মতো। তবে এ চেষ্টার ধরনটার প্রচার খুবই কম হয়। বাংলাদেশেও বেশিরভাগ এখনও মঞ্চমুখী। আপনার দৃষ্টিতে ভাল থিয়েটার আসলে কেমন? আশীষ গোস্বামী : ভাল থিয়েটার করার জন্য অর্থের প্রয়োজন। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আবার ভাল থিয়েটার বা এর বিষয়ে প্রচারের জন্য খরচাপাতির যোগাড় সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশে অনেক ভাল কাজ নিশ্চয় হচ্ছে, ভাল থিয়েটার হচ্ছে, কিন্ত দর্শক ঠিক সেভাবে আসছে না। দর্শক অনেক চুজি হয়ে গেছে। বড় দলগুলোর হয়ত স্টার আছে। আবার এমনও আছে কোন কোন দল ব্রান্ড হয়ে গেছে। তাদের দলে স্টার না থাকলেও নিয়মিত দেখতে আসে। আর ঢাকা শহরে যানজটসহ সমস্যা আছেই। একটা থিয়েটার দেখতে আসা মানে টাকাটা খরচ হওয়া। নানা সমস্যা পার করে থিয়েটার দেখতে আসা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এ অবস্থায় ঢাকা শহরের চারদিকে যদি হল থাকত, চারিদিকে অপসন থাকত, কিংবা টিকেটের দাম যদি একটু কম হতো, ট্রাম, বাসের অবস্থা যদি ঠিক থাকত তাহলে হয়তো দর্শক পাওয়া যেত। এ অবস্থায় থিয়েটারের জন্য আশা জাগানিয়া বিষয় কি হতে পারে? আশীষ গোস্বামী : অবশ্যই আশা জাগানিয়া কিছু আছে। এদেশের সংস্কৃতিবান মানুষদের সহায়তায়, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্ত মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। সেখানে নাটক মঞ্চায়ন হচ্ছে, নতুন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, দর্শক বাড়ছে। এই চেষ্টাগুলো যদি কয়েক বছর আগে হতো তবে থিয়েটার আরও অনেক এগিয়ে যেত পারত। মফস্বল এলাকায় একটা থিয়েটার থাকা বা হল থাকায় নানাভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকা- হয়। সেক্ষেত্রে সেটা একটা ভাল উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে। এটা একটা ভাল দিক বাংলাদেশের থিয়েটারের জন্য। এতে থিয়েটার বেশ সুবিধা পায়। সামগ্রিকভাবে থিয়েটারটাকে এগিয়ে নেয়া যায়। আপনি বিকল্প থিয়েটারের কথা বলছেন সেটা কেমন? আশীষ গোস্বামী : হ্যাঁ বিকল্প থিয়েটার মানে লোকে ভাবে মঞ্চের বাইরের থিয়েটার, অবশ্যই মঞ্চের বাইরের থিয়েটার। কিন্ত আমি বলি অন্য কথা, ফ্রি, বা এক্সপেনসিভের পাশাপাশি একটা লো বাজেটের থিয়েটার কীভাবে করা যায়। বাদল সরকার এটাকে বলতেন ফ্রি থিয়েটার। অর্থাৎ অর্থমুক্ত থিয়েটার। ফ্রি থিয়েটার মানে হচ্ছে মঞ্চ নাটক করতে গিয়ে আমার যে অর্থ বা টাকা খরচ হয়, সেটা যদি এমন জায়গায় নিয়ে আসা যায় নাটক মঞ্চায়নে কম দর্শক হলেও যেন আমার প্রযোজনার খরচটা পুষিয়ে যায়। এই চেষ্টাটা উনি শুরু করেছিলেন। সেই চেষ্টাটা এখন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে লো বাজেটের থিয়েটার অভিনয়, শারীরিক কসরত এবং অভিনেতাকে এনার্জির ওপর বেশ জোর দিতে হয়। অনেক বেশি ইনডিভিজ্যুয়াল পরিশ্রম করতে হয়। অর্থাৎ থিয়েটারটা দেখার জন্য তো দর্শকরা একটি নির্দিষ্ট হলে আসে। সাধারণ দর্শকের নাগালের মধ্যে থিয়েটারটা হতে হবে। এক্সপেনসিভ এর পাশাপাশিলো বাজেটের থিয়েটারের কথা ভাবা যেতে পারে। সেটা কি পথনাটকের আদলে হতে পারে? আশীষ গোস্বামী : না। পথনাটকে তো একটা পলিটিক্যাল পারপাস থাকে। কিন্ত পলিটিক্যাল পারপাসে তো সবাই রাজি নয়। সেটা বিকল্প থিয়েটারের একটা উপায়। এ ছাড়া আরও নানবিধ উপায় রয়েছে। বাদল সরকার যেমন করেছেন থার্ড থিয়েটার। কেউ বলতেন অঙ্গন মঞ্চ। আর মঞ্চনাটক দেখতে যাওয়া মানে তাতে পরিচালক দর্শককে সরাসরি ডিকটেট করে। পরিচালক শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ডিকটেট করে না, দর্শককেও করে। বলা যায় মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে ডিরেক্টরের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে হয়। দর্শককে এক জায়গায় বসতে বাধ্য করে দেখতে ও শুনতে বাধ্য করে। বিষয়টা এমন যে আমি একটা থিয়েটার করছি, আপনি আপনার ইচ্ছে মতো দেখুন। ভারতবর্ষে একটা থিয়েটার হয় যেখানে কোন সিট নেই, একটা ঘরের মধ্যে আপনি ঢুকলেন, ঢোকার পরেই পারফরমেন্স শুরু হয়ে গেল। একেকটা সিকোয়েন্স দু রকম করে করছে। যেটা ভাল লাগছে দর্শক সেটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেমন ধরুন একটা সিন, একটা স্থানে নরমালি করছে, আরেক জায়গায় পাপেট দিয়ে করছে। দর্শক দুটোই কম্পেয়ার করছে, যেটা তার ভাল লাগছে সেখানেই সে দাঁড়াল। এটা একেবারেই এক্সপেরিমেন্ট। থিয়েটারের বিষয়গুলো এমন হওয়া উচিত যে, একই বিষয় বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হবে। সেখানে দর্শক তার স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে যেটা ভাল লাগবে সেটা দেখতে পারবে। এ বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? আশীষ গোস্বামী : আমি ভারতে একটি ঘরের ভেতর শুধু টিউব লাইট জ্বালিয়ে অভিনয় হচ্ছে। এখানে আলোর খরচটা কমে গেছে। দর্শকেরও স্বাধীনতা আছে। নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট ভারতবর্ষে হচ্ছে। আবার আসামের একটি স্থানে ঘন জঙ্গলের ভেতর একটু বেড়া দিয়ে স্টেজের মতো করে, শাল গাছের মধ্যে থিয়েটার হচ্ছে দিনের বেলায়। সেখানে কোন মঞ্চ নেই, লাইট বা মিউজিকের ব্যবহার নেই। দিনের আলোতে নাটক করছে তারা। একটি স্থানে মাদুরের মতো কিছু একটা দাঁড় করিয়ে মঞ্চ বিন্যাস দেখানো হয়েছে। আর বাস দিয়ে দিয়ে গ্যালারির তৈরি স্থানে বসে দর্শক গাছের ছায়ায় বসে সেটা দেখছে। সকাল ১০টা এবং বিকেল ৩টায় শো হচ্ছে। দুই থেকে আড়াই হাজার দর্শক সেটা দেখছে। এই থিয়েটারটা এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে ভারতবর্ষে যারা বিকল্প থিয়েটার করে তারা সবাই এই থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে চায়। মানে তার এতই বড় একটা স্টান্ডার্ট তৈরি হয়েছে। এভাবে ভারতবর্ষে নানা স্থানে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করছে থিয়েটারের লোকেরা। তারা সফলও হচ্ছে। বাংলাদেশে এই বিকল্প থিয়েটারের সম্ভাবনা কতটুকু? আশীষ গোস্বামী: আজ হোক কাল হোক যে থিয়েটার ভালবাসে তাকে এখানে আসতেই হবে। এক্সপেনসিভ থিয়েটারের পাশাপাশি এই থিয়েটারে আসবেই। এ জন্য মুক্তমঞ্চগুলো তৈরি হচ্ছে। যেমন বরিশালের শব্দাবলির স্টুডিও থিয়েটার হয়েছে। সেখানে ৫০ জন একসঙ্গে থিয়েটার দেখছে। সেখানে প্রতি শুক্রবার তো অভিনয় হয়। আর নিজের যদি একটা জায়গা থাকে তবে ইচ্ছেমতো এক্সপেরিমেন্ট করা যায়। নানা আইডিয়া মাথায় আসে। আমরা বুঝি না বুঝি মঞ্চ নাটকটা কিন্ত বদলে বদলে যায়। কিন্ত কাউকে যদি বিশেষ করে, ধরুন বাচ্চু ভাইয়ের মত মানুষ, মামুনুর রশিদের মতো মানুষকে যদি বলা হয় যে ১০ বছরের জন্য তোমাকে এটা দিয়ে দিলাম, সে তখন কিন্ত অনেক কিছু আইডিয়া বের করবে। যেমন ধরুন আমরা আমাদের লিজেন্ড ধরি উৎপল দত্তকে, তিনি কিন্তু তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলো করেছেন যখন মিনার্ভা থিয়েটার তার অধীনে ছিল। মিনার্ভা থিয়েটারে তৎকালীন একটা ভাঙ্গাচোরা হলে কিন্তু শ্রেষ্ঠ কাজগুলো হয়েছে। এই জন্য নিজের একটা জায়গা থাকাটা বড় জরুরী এখন। সেটা যেভাবেই হোক, খোলা হোক বা অন্য কোন স্থানে হোক। কিন্তু মঞ্চটা তো সাধারণত নিজের হয় না। স্টুডিওতে তখন নিজের মতো করে কাজ করতে পারে। আর একটা হয় যে প্রতিনিয়ত নতুন নাটকেরও একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। নতুন নতুন ক্রিয়েশনের একটা চ্যালেঞ্জ নিতে হয়, না হলে দর্শক আর আসবে না। আর একটা ব্যাপার টিকেটের দামটা কম হয়, খরচটা কমে যায়, টিকেটের দাম টাও কমে যায়।এখানে শুভাসিন সিনহা এক ধরনের থিয়েটার করছে। যেটা শহর থেকে মানুষ দেখতে যায়। আমি শুনেছি সেখানে সে খুব ভালভাবে থিয়েটারটা করে। তার স্বীকৃতিও সে পেতে শুরু করেছে। সুতরাং এই যে বিষয়টা এই জায়গাটা যত বাড়বে আমাদের থিয়েটারও তত সমৃদ্ধ হবে। নয়ত থিয়েটার বাঁচবে না। আপনি কোন্টাকে বেশি অগ্রাধিকার দেন, গবেষণা, নাটক নির্মাণ না কী রচনা? আশীষ গোস্বামী : আমি বিকল্প থিয়েটারের অনুসন্ধান, প্রসার এবং প্রচারের কাজ করছি। জরুরী বিষয় হচ্ছে থিয়েটারের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ।এখন আমি ঢাকা থিয়েটারেরটা করছি। এর আগে করেছি, আরণ্যক, থিয়েটার, লোক নাট্যদল, শব্দাবলি, চট্টগ্রামের তির্যক, ওপার বাংলায় সংস্কৃতি, অন্য থিয়েটার, রথন থিয়ামের কোরাস রিপার্টরি থিয়েটারের করেছি। বাইরে থেকে এসে আমি বেশি কাজ তো করতে পারব না। কাজটার গুরুত্বটা যদি বোঝাতে পারি, কারণ থিয়েটার চর্চার ঐতিহাসিক উপাদানগুলো সংরক্ষণ জরুরী। এটা না হলে থিয়েটারের ইতিহাস লেখাই হবে না। থিয়েটার এগোবে না। থিয়েটারটা হলো লিভিং আর্ট। সব সময় পরিবর্তন হয়। সুতরাং থিয়েটারের ইতিহাস সংরক্ষণ জরুরী। -সাজু আহমেদ
×