ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল

স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে ভর করে জেগে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চল

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৮ নভেম্বর ২০১৭

স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে ভর করে জেগে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চল

স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদলের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেতুকে ঘিরে সোনালি ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছেন এ অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে এসব অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগ কাড়বে, গড়ে উঠবে এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা। এ সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর পর এসব প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা হলো- বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি। খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা। ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় শিল্পায়নের কাজ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মংলা বন্দরে পদ্মা সেতুর সুফল এখনই পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। গার্মেন্টসসহ রফতানিমুখী নানা ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। জাতীয় সংসদের সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর মতে, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার আগেই দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় ‘শিল্প বিপ্লব’ ঘটবে। ২০১৮ সালের পর অর্থনীতিতে এর সুফল পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, ২০৫ একর জমি নিয়ে এ অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে। এ অঞ্চলে ইপিজেড আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে সামনে রেখে। রেলের কাজ চলছে পুরোদমে। এর সঙ্গে চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ এবং পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হলে দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল। তিনি আরও বলেন, বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালবাসা রয়েছে। বিগত দিনে তিনি যেমন বরিশালের জন্য ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন, বর্তমানেও সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখছেন। এর অংশ হিসেবে কয়েকদিন পূর্বেও প্রধানমন্ত্রী বরিশালের কীর্তনখোলার পাড়ে শহররক্ষা বাঁধ তৈরিতে ৩৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। তিনি (আবুল হাসানাত) বলেন, আগামী দিনে ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণের পর বরিশাল হবে দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর। জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পীকার ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস এমপি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুততম হবে। এতে সময় ও যাতায়াত খরচ কমবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ অঞ্চল থেকে দেশের দূর-দূরান্তে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীরাও দারুণভাবে উপকৃত হবেন। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে জ্বালানির চাহিদা নিশ্চিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যুগান্তকারী উন্নয়ন হবে। এ অঞ্চলের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি আসবে, আয় বৈষম্যও কমে যাবে। এছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মংলা বন্দরের মাধ্যমে রফতানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর পায়রা বন্দরের গুরুত্বও বাড়বে। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়নের পর পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এ বন্দরও এক বৃহত্তম বন্দরে রূপান্তরিত হবে। এমনকি ভুটান, পূর্ব নেপাল ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশের জন্য পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ বলেন, ভবিষ্যতে এ সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারবে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর সড়ক ও রেলপথ এ দুইয়ের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, রফতানি বাড়াতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি দেশের ভেতরে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পাবে। বরিশাল-৫ আসনের সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা আফরোজ বলেন, পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দেবে। গ্যাস-বিদ্যুত ও অবকাঠামোর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে দেশে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের সাবেক পরিচালক এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে মাথায় রেখে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে মানুষ নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছেন। সামনে আরও নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর চালু হতে যাচ্ছে। মংলা বন্দরেরও প্রসার ঘটছে, ইকোনমিক জোন হচ্ছে। এ কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নের সুফল পেতে এখনই গ্যাস-বিদ্যুত ও অবকাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে। বরিশাল চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আলহাজ সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা দেখে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাতেই নতুন নতুন শিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর সুফল পেতে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। ভ্যাট, ট্যাক্স আরোপের নামে অহেতুক হয়রানি করা না হলে ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলকে বেছে নেবেন। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে বরিশালের আগৈলঝাড়া, ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং খুলনার খালিশপুরের অর্থনৈতিক জোনের সীমানা নির্ধারণ হয়েছে। আগামী দশ বছরের মধ্যে এ অঞ্চল বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বরিশালের কৃতী সন্তান, প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের পরিচালক ও বাংলাদেশ যুব মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মোঃ আতিকুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগ বাড়বে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন হবে। বেনাপোল ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বাড়বে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় নানা রকম শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু হচ্ছে, এর সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস আর বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো গেলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হবে শিল্পের নগরী। ইতোমধ্যে কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও নতুন করে জুটমিল এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা ও ইপিজেড করা হয়েছে। পায়রা বন্দরে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে। তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফোর লেনের রাস্তারও দাবি করেন। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের একমাত্র চ্যালেঞ্জ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছে গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এ সেতুতে মোট ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এ সেতুর কাজ শেষ হবে বলে আশা করছে সরকার।
×