ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতুর ৪ খুঁটিতে একটি করে পাইল বাড়তে পারে

বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যামার মাওয়া পৌঁছেছে, গতি বাড়বে পাইলিংয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৮ নভেম্বর ২০১৭

বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যামার মাওয়া পৌঁছেছে, গতি বাড়বে পাইলিংয়ে

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার হ্যামার এখন মাওয়ায়। শুক্রবার এটি পদ্মা সেতু প্রকল্পে এলাকায় পৌঁছেছে। এটি এখন ব্যবহার উপযোগী করার প্রস্তুতি চলছে। সাড়ে ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি জার্মানিতে তৈরি। পদ্মা সেতুর জন্য অর্ডার দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। এর আগে ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার আরেকটি হ্যামার আনা হয়েছিল। টেকনিক্যাল কারণে সেটি সচল করা যায়নি। তবে এটি শীঘ্রই পাইল ড্রাইভ শুরু করবে বলে দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। জার্মান থেকে নেদারল্যান্ডস হয়ে সমুদ্র পথে এই মংলা এসে পৌঁছে। পরে বিশেষ জাহাজে করে এটি আনা হয় মাওয়ায়। এদিকে ২৪শ’ কিলোজুল এবং ১৯শ’ কিলোজুল ক্ষমতার দু’হ্যামার এখন ২ ও ১৪ নম্বর খুঁটিতে পাইল ড্রাইভ করছে। এখন নতুন এই হ্যামার বহরে যোগ দেয়ায় পাইল স্থাপনের গতি বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন পদ্মা সেতুর চারটি খুঁটিতে (পিয়ার) একটি করে পাইল বাড়াতে হতে পারে। তাহলে ছয়টির স্থলে সাতটি করে পাইল স্থাপন করতে হবে। নদীর তলদেশের মাটি নরম থাকার কারণে মাওয়া প্রান্তের ৬, ৭, ৮ ও ১০ নম্বর পিয়ারে এই পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র শুক্রবার এই আভাস দিয়ে বলেছে, ডিসেম্বর মাসে চারটিসহ পদ্মা সেতুর বাকি ১৪টি পিয়ারের ডিজাইন চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। পদ্মা নদীর ¯্রােতে যেমন বৈচিত্রময়, ঠিক নদীর তলদেশেও রয়েছে নানা বৈচত্রময় মাটির গঠন। তাই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতু নির্মাণযজ্ঞ। পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, যে চারটি পিয়ারের নিচের মাটির নরম নিয়ে চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, সেগুলোর গভীর ১২৮ মিটারের পরিবর্তে ১৩৫ মিটার করতে গেলে পাইলের টিউব পরিবর্তন করতে হবে। বেশি ক্ষমতাধর হ্যামার প্রয়োজন। এসব বিবেচনায় গভীরতা বৃদ্ধির বিকল্প হিসেবে প্রতিটি খুঁটিতে ছয়টির পরিবর্তে সাতটি পাইল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। তবে ৬ ও ৭ নম্বর খঁটিতে তিনটি করে বটম পাইল করে রাখা হয়েছে প্রায় বছর দুই আগে। নতুন ডিজাইনে এই বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এভাবেই বড় একটি চ্যালেঞ্জ সফলতায় রূপ নিচ্ছে। এদিকে আসন্ন ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে আরও দু’টি স্প্যান উঠানোর টার্গেট নেয়া হচ্ছে । ৩৯ নম্বর খুঁটিতে পিয়ার ক্যাপ ঢালাইয়ের কথা রয়েছে ২৫ নবেম্বর। এই ঢালাইয়ের ১৪ দিন পরেই স্প্যান ওঠার কথা রয়েছে ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুুঁটিতে। এই দু’খুঁটিতে বসবে ৭বি নম্বর স্প্যান। এছাড়া ৪০ নম্বর খুঁটিও দ্রুত প্রস্তুত হচ্ছে। এই খুঁটির ওপরের অংশে দ্বিতীয় ধাপের কাজ শেষ দিকে। তাই ৩৯ নম্বর খুঁটির পাঁচ দিন বাদেই ৪০ নম্বর খুঁটির পিয়ারক্যাপ ঢালাই হওয়ার কথা রয়েছে। এই ক্যাপেই বেয়ারিং দিয়ে এর ওপর স্থাপন হবে স্প্যান। তাই দ্রুত গতিতে চলছে এসব কাজ। একই গতিতে মাওয়ার পাশের কুমারভোগ ওয়ার্কসপে ৭বি ও ৭সি নম্বরের দু’টি স্প্যান প্রস্তুত করা হচ্ছে। এদিকে ৪২ নম্বর খুঁটির কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। এই খুঁটির ওপরের অংশে বেইজ ঢালাই হয়ে এখন ওপরের দিকে উঠছে। তবে সম্প্রতি পাইল স্থাপন সম্পন্ন হওয়ায় ৪১ নম্বর পিয়ারের কাজ একটু বিলম্ব হচ্ছে। তারপরও ৪১ নম্বর খুঁটিও তৈরি করা হচ্ছে তোরেজোরে। এতে আরও দু’টি স্প্যান বসবে পরবর্তীতে কিছু সময়ের মধ্যে। এতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ৫টিই দৃশ্যমান হবে। জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সেতুর সব পাইল স্থাপন সম্পন্ন হওয়ার পর এখন মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সেতুর (ভায়াডাক্ট) পাইল স্থাপনে নতুন গতি পেয়েছে। এই প্রান্তে ১৭২টি পাইলের মধ্যে ৩০টি পাইল বসে গেছে। বর্ষা বিদায় নেয়ায় পদ্মা পুরোপুরি শান্ত। ¯্রােতের তীব্রতাও কম। তাই নদী শাসনের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। সেতুতে মোট ৪২টি খুঁটির (পিয়ার) এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। এই দু’টি খুঁটির মাঝে বসছে স্প্যান। ১৫০ মিটার দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই একে একে সেতু নির্মিত হচ্ছে। পদ্মা সেতুর প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি করে পাইল বসানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে নদীতে পাইলের সংখ্যা ২৪০টি। তবে এর সঙ্গে আর চারটি নতুন করে যুক্ত হতে যাচ্ছে। ইস্পাতের এসব পাইল মাটির নিচে ৯৬ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে বসানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৯৩টি পাইলিং হয়েছে। পেছনে তাকালে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। তাতে খরচ ধরা হয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আর নদী শাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নবেম্বরে। এই কাজের খরচ ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া দুই প্রান্তে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক, অবকাঠামো নির্মাণ করছে দেশীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।পদ্মা সেতুর প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। দ্বিতল বিশিষ্ট পদ্মা সেতু হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ অর্থাৎ সংযোগ সেতু ধরলে সেতুটি প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। খুঁটির ওপর ইস্পাতের যে স্প্যান বসানো হবে, এর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়।
×