ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নবান্ন উৎসব আজ শেষ

লোকজ সংস্কৃতির টানে সবাই ছুটছেন রবীন্দ্র সরোবর

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৮ নভেম্বর ২০১৭

লোকজ সংস্কৃতির টানে সবাই ছুটছেন রবীন্দ্র সরোবর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলছে ‘নবান্ন উৎসব’। জারি-সারি, বাউল ও ভাওয়াইয়া গানসহ নানান সাংস্কৃতিক কর্মকা- উপভোগ করতে উৎসুক জনতায় মুখরিত ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর। ১৬ নবেম্বর থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এ উৎসবে দেশীয় ঐতিহ্যের পরশ পেতে ছুটছেন রাজধানীবাসী। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় সকাল থেকেই মেলা প্রাঙ্গণে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সন্তান, পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি উৎসবকে করেছে মুখরিত। ব্যস্ত রাজধানীতে বন্দীপ্রায় শিশুরাও যেন স্বস্তি পেয়েছে মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরতে এসে। বর্তমান সময়ের অনেক শিশুই জানে না বাঙালীর লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কে। জানে না নবান্ন উৎসব কি। আবহমান বাংলার সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা শিশুসহ সবার কাছে বাংলার লোকজ সংস্কৃতি নতুন করে সামনে আনতেই ‘প্রাণ চিনিগুঁড়া চাল’ আয়োজন করছে নবান্ন উৎসব-১৪২৪। ‘নবান্ন উৎসবে’ মঞ্চে গান আর মঞ্চের বাইরে পিঠা উৎসব এমন উন্মুক্ত আয়োজনে নবান্নের আনন্দে মেতেছে রবীন্দ্র সরোবর। বাঙালীর ঐতিহ্যকে ধারণ করে মেলা প্রাঙ্গণে ছন আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ৩২টি স্টল। বাংলার নবান্নের ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পুুলি, পায়েসসহ নানা ধরনের খাবার পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। শুধু তাই নয় নাগরদোলা, পুতুল নাচ, বায়োস্কোপ, বানর নাচ, সাপ খেলা ও ঢেঁকিসহ গ্রামবাংলার নানান ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ থাকছে সেখানে। এছাড়া তরুণ প্রজন্মকে বাঙালীর ঐতিহ্যকে বোঝানোর চেষ্টায় ভাওয়াইয়া, একক সঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি ও পথনাটকসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রায়ের বাজারের বাসিন্দা কাকলী ইসলাম ঘুরতে এসেছেন সপরিবারে। তার মেয়ের বয়স পাঁচ বছর। বাঙালীয়ানার সঙ্গে পরিচিত করতে মেয়েকে নিয়ে প্রথমবারের মতো এ নবান্ন উৎসবে বেড়াতে এলেন কাকলী। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘রাজধানীর প্রায় সব শিশুরাই গৃহবন্দী। কোন খেলার মাঠ নেই, বেড়াতে যাওয়ার স্থানও কম। শহুরে সংস্কৃতির বাইরেও যে বাঙালীর এতিহ্যবাহী সংস্কৃতি রয়েছে তার ছোঁয়া পেতেই মেয়েকে নিয়ে এখানে আসা। মেয়েকে সাপ খেলা, বানর খেলা, দেখিয়েছি। আসলে এর আগে সে কখনও দেখেনি এসব। তাই অনেক উৎসুক হয়ে দেখছে মেলা প্রাঙ্গণ। এখন তো যেতেই চাইছে না। গ্রামবাংলার এসব ঐতিহ্য বর্তমানে বিলীন হয়ে গেছে। এমন আয়োজন সত্যিই রাজধানীবাসীকে বাঙালীর চিরচেনা ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন করে সেতুবন্ধন ঘটাতে সক্ষম।’ শুক্রবার রবীন্দ্র সরোবরে নবান্ন উৎসব চলছে জেনে স্বামী ও স্কুল পড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে এসেছেন শায়লা হক। কিনেছেন নানা ধরনের পিঠা। তিনি বলেন, ছোটবেলায় বাবা-মা, মুরব্বিদের কাছে শুনেছি-ধান দিয়ে আসে নবান্ন। ধান আসবে, কৃষাণী হাসবে, ছেলেমেয়ে খেলবে এটাই বাংলার চিরাচরিত অধ্যায়। আর এটাকে ঘিরেই নবান্ন উৎসব। তবে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই উৎসব। রাজধানীর অনেকেই এই উৎসব সম্পর্কে জানে না। তাই আমার সন্তানকে এই উৎসবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এসেছি। নিজেরা ঘুরে ঘুরে নানা পিঠা-পুলি কিনেছি। বাচ্চাকে নাগরদোলায় চড়িয়েছি, সাপ খেলা, বানার খেলা দেখালাম। প্রাণের এই নবান্ন উৎসবে নাতি-নাতনিকে নিয়ে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন মোহাম্মদ তায়েব। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী উৎসব নবান্ন উৎসব। এটি শহরের অনেক মানুষের কাছে অপরিচিত। তাই আমার নাতি-নাতনিকে এই উৎসবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এখানে এসেছি। নাগরদোলা, সাপ-বানরের খেলা, বায়োস্কোপ দেখে তারা সত্যই অভিভূত। এমন আনন্দ তারা এর আগে পায়নি। প্রতিবছর এ ধরনের উৎসব পালিত হলে রাজধানীর শিশুরা বাঙালীর লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হবে।’ পুথিপাঠ, গাজীর কিস্সা, পালা গান, পুতুল নাচ, বায়োস্কপ, নাগরদোলা, পালকি, লাঠি খেলা ও বানর নাচে ভরপুর এ নবান্ন উৎসবে এসে তরুণ-তরুণীরাও যেন নতুনভাবে বাঙালীয়ানাকে ঝালিয়ে নিচ্ছেন। মেলার ঘুরতে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও মিলনমেলা ঘটছে। তাদের মধ্যে তামান্না নামে একজন জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যস্তময় শহরে বিনোদনের জায়গাগুলো কমে যাচ্ছে। তাই কোথাও মেলা বা বিনোদন কেন্দ্র বসলে ছুটে যেতে ইচ্ছা করে। তাই বন্ধুদের নিয়ে এসেছি নবান্ন উৎসবে।’ তাদের আরেক বন্ধু আবেদ রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার বৃষ্টির কারণে আসিনি। তবে আজকে আর মিস করলাম না। বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে চলে আসলাম নবান্ন উৎসবে। এখানে এসে নতুনভাবে বাঙালীয়ানার সঙ্গে পরিচিত হলাম। সব মিলিয়ে অনেক ভাল সময় কাটছে। আমরা সবাই নাগরদোলায় উঠেছি, পিঠা খেয়েছি। এছাড়া বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো দেখে খুবই আনন্দ পেয়েছি।’ আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসবের সঙ্গে শহরবাসীকে পরিচয় করিয়ে দিতেই এই আয়োজন। এ আয়োজনে শহুরে মানুষেরা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের স্বাদ পাচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এই নবান্ন উৎসবে শেষ দিন আজ শনিবার। প্রতিদিনের মতো আজও সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলা এই মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মেলার দায়িত্বরত বঙ্গ মিলারস্ লি. কোম্পানির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মোঃ মুস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, ‘বাংলার ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে আমরা দ্বিতীয়বারের মতো তিন দিনব্যাপী এই মেলার আয়োজন করেছি। মূলত তরুণ প্রজন্মের সামনে বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি তুলে ধরতেই এই মেলার আয়োজন। এর মাধ্যমে আমরা বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্নকে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গ্রাম-বাংলার নবান্নর চিত্র তুলে ধরা হবে। এখানে এসে শহরের শিশুসহ সব বয়সী মানুষ নবান্নর সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করবে। কালের বিবর্তনে আমাদের সংস্কৃতি থেকে অনেক ঐতিহ্যবাহী উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে। নবান্ন উৎসবের মতো এমন গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসব শহরের মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়াই এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।’ উৎসবের বিভিন্ন আয়োজনের পাশাপাশি রয়েছে সাংস্কৃতিক পর্বে গান পরিবেশন। জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, ফকির আলমগীর, আবু বকর সিদ্দিক, লিলি ইসলাম, অনিমা রায়, ফেরদৌসী কাকলীসহ বিভিন্ন শিল্পীদের মনমাতানো গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গানগুলো যেন উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
×