ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সৌম্য সালেক

ব্লাইন্ডনেস ॥ অন্ধত্বের আখ্যান

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

ব্লাইন্ডনেস ॥ অন্ধত্বের আখ্যান

ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে পড়া গাড়ির এক ড্রাইভার দেখতে পেল সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে, দু’পাশের গাড়িগুলো এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মাঝের সারির একদম সামনের গাড়িটা থেমে আছে। পেছনের গাড়িগুলোর খেপে ওঠা চালকরা বার বার হর্ন বাজিয়েও যখন কোন ফল পাচ্ছিল না তখন ওরা রেগে-মেগে থেমে থাকা গাড়িটার বন্ধ জানালায় আঘাত করতে লাগল। তাদের একজন গাড়ির দরজাটা খুলে ফেলল এবং দেখল, লোকটি চিৎকার করে বলছে ‘আমি অন্ধ, সবকিছু সাদা দেখছি, আমি যেন কোন দুধের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি, আমি অন্ধ হয়ে গেছি।’ জোসে সারামাগো তাঁর ব্লাইন্ডনেস উপন্যাসে এক নতুন অন্ধত্বের দৃশ্য উন্মোচন করেন যা অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। এটা ছিল আসলে একটা শ্বেত-অন্ধত্ব যেটি খুব দ্রুত গাড়িচালক লোকটির মাধ্যমে নগরময় ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে অন্ধ হওয়া কয়েকজন লোক একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয় কিন্তু রোগ সম্পর্কে গভীর নিরীক্ষণে নিয়োজিত এক বিশেষ মুহূর্তে তিনি নিজেই ‘আমি অন্ধ হয়ে গেছি, আমি সব কিছু সাদা দেখছি’- বলে চিৎকার করে উঠলেন। আমরা এ গ্রন্থের পুরো আখ্যান ভাগজুড়ে কেবল একজনকে চক্ষুষ্মান দেখতে পাই তিনি এই ডাক্তারের স্ত্রী, লেখক কাহিনীচিত্রে যাকে ‘ডাক্তারগিন্নী’ বলে উপস্থাপন করেছেন। জোসে সারামাগো তাঁর গ্রন্থটিতে বলতে চেয়েছেন ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা শিখেছি অন্ধ বলতে আসলে কেউ নেই, এখানে যা বিরাজমান তা হচ্ছে অন্ধত্ব।’ অর্থাৎ রাষ্ট্র যখন স্খলন, অমানবিকতা, অসমতা ও নেতিবাচকতায় নিমজ্জিত থাকে, তখন ব্যক্তি বিশেষের সক্ষমতা নিষ্ক্রিয় হয় এবং তারা নিরুপায় হয়ে কেবল আক্রান্ত হতে থাকে। এই অন্ধত্ব ব্যক্তি বিশেষের কৃতকর্মে সৃষ্টি হয় না বরং রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব থেকে এটা সমগ্রপৃষ্ঠে চেপে বসে। সারামাগোর এসব বক্তব্যের চেয়ে যা আখ্যানটিকে অভিনব বলে প্রচার দিয়েছে তা হলো এর অদ্ভুত দৃশ্যপট এবং দৃশ্যগুলোর হতচেতন করা বর্ণনা। এটা আসলে চরম নাস্তিবোধের প্রকাশ এবং সার্বিকভাবে এক নগ্ন-উন্মোচন। কেউ নিজে এমন ত্রাহি অবস্থায় পতিত না হয়ে কীভাবে এমন বর্ণনা সম্ভব, এটিই এক বিস্ময়! নরকের যেসব বর্ণনা প্রচলিত আছে, এই কাহিনী তার থেকে কম জঘন্য নয়! গোটা শহরটাই এক সময় অন্ধত্বে পতিত হলো, তার উপর কোয়ারান্টাইনকৃত অন্ধদের মাঝে আবির্ভাব ঘটে একদল গু-ার, তারা সাধারণ অন্ধদের উপর চড়াও হয়ে এমন সব নারকীয়তা প্রদর্শন করে, যাকে ভাষায় প্রকাশ করা খুব দুরূহ কাজ। এই উপন্যাস পাঠ শেষে, কারও এমন ভাবাটা অযৌক্তিক হবে না যে, সারামাগো নিজেই কী এই শ্বেত-অন্ধত্বে আক্রান্ত? নতুবা কীভাবে এমন অনুপুঙ্খ বর্ণনা সম্ভব! সারামাগো তাঁর এই উপন্যাসে স্থান-কাল-পাত্রের গতানুগতিক শৃঙ্খলাকে লঙ্ঘন করেছেন। এটা একটা নগরের বর্ণনা, কিন্তু কি তার নাম তা উল্লেখ নেই, কোন সময়ে এমনটা ঘটেছে তারও হদিস নেই আর নেই কোন পাত্র-পাত্রির নাম চিহ্নও। তবে আখ্যানজুড়ে আমরা কিছু চরিত্রের সাক্ষাত পাই, যার প্রত্যেকজনকে লেখক একটি পরোক্ষ বিশেষণে পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের সক্রিয় চরিত্রগুলো হলো ডাক্তার গিন্নী, ডাক্তার, কালো চশমার মেয়ে, কালো পটির বুড়ো, টেরা চোখের ছেলে, প্রথম অন্ধ লোক, প্রথম অন্ধের স্ত্রী, অশ্রু চাটা কুকুর, অন্ধ সন্ত্রাসীদের সর্দার এবং অন্ধ সন্ত্রাসীদের হিসাবরক্ষক। ব্লাইন্ডনেস, প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। পর্তুগিজ ভাষা থেকে বইটির ইংরেজী অনুবাদ শেষ করেই জিওভান্নি পন্টেইরো মৃত্যুবরণ করেন, তিনি অনুবাদের পুনঃপাঠও করে যেতে পারেননি। পরে মার্গারেট জুল কোস্টার পুনর্পাঠ শেষে ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে গ্রন্থটির ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। জোসে সারামাগো নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৯৮ সালে। ‘ব্লাইন্ডনেস’ প্রকাশের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকগণের কলম থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গ্রন্থটি সম্পর্কে নানান ভূয়সী প্রশংসা বাক্য প্রকাশিত হয়। বোস্টন গ্লোব-এ রবার্ট টেইলর লিখেছেন ‘একজন সাহিত্যাধিপতির এ এক মর্মঘাতী সৃষ্টি... গুণাবলীতে অনন্য এক গ্রন্থ।’ হ্যারাল্ড ব্লুম লিখেছেন- ‘অন্ধত্ব হচ্ছে সারামাগোর সবচেয়ে চমক জাগানিয়া এবং বিরক্তিকর গ্রন্থ। উদ্ভট কল্পনার আশ্রয়ে রচিত এ উপন্যাস আমাদের ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত সামাজিক প্রেক্ষিত, যা সদা বিরাজমান এবং থাকবেও, তাকে উন্মোচন করে পাঠককে প্রচ- ধাক্কা দেয়া এ উপন্যাস স্থায়িত্ব পাবে।’ আমান্দা হপকিনসন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় মন্তব্য করেন ‘সারামাগো এমন এক আবাহ তৈরিতে দক্ষ, যেখানে হঠাৎ করেই সমাজটা পঙ্গু হয়ে যায় আর পাঠক বুঝতে পারে যৌথ জীবন কাকে বলে।’ বিখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী নিউইয়র্কারে বলা হয় ‘সারামাগোর অধিবাস্তবতার এই রূপকাশ্রয়ী কাহিনী সত্য দর্শনের সাহসী মানবিক এক অভিযান, মানবিক সৌরভে যা সবচেয়ে অসম্ভবতা আর অবিচারের চূড়ান্তকে অতিক্রম করে যায় অবলীলায়, যদিও তিনি এতে চিরচেনা জীবন সংগ্রামকে আবিষ্কার করেছেন নতুনভাবে, খেয়ালি মুন্সিয়ানায়।’ জিওভান্নি পন্টেইরো-কৃত ইংরেজী থেকে খুবই ঝরঝরে গদ্যে ‘ব্লাইন্ডনেস’- এর বাংলা অনুবাদ করেছেন মনজুর শামস, এই নিবন্ধকার স্কাই পাবলিশার্স কর্তৃক ২০১১ সালে প্রকাশিত পুস্তকটি পাঠপূর্বক দু’কথা বলতে মনস্থ হয়েছে। (দুই) জোসে সারামাগো তাঁর উপন্যাসটিতে গতানুগতিক কোন কাহিনী উপস্থাপন করেননি। তিনি আসলে সমাজ ব্যবস্থার স্খলনকে উপস্থাপনের জন্য একটি ভৌতিক পটভূমি বেছে নিয়েছেন; অকালসম্ভব এই বর্ণনা যেমন পাঠককে গভীর অভিনিবেশে আকর্ষণ করেছে সেই সঙ্গে তাঁর বক্তব্যও পরিকল্পনামাফিক এগিয়েছে। ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপন্যাসের আখ্যান কোন দীর্ঘ গল্পের বিন্যাসে এগিয়ে চলেনি। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা যা দেখি তাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্রমপর্বে উল্লেখ করলে আমরা পাব- শ্বেত-অন্ধত্ব ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা, অন্ধদের একটি মানসিক হাসপাতালে তথা কোয়ারেন্টাইনে জড়ো করা, সেখানে নানা বিশৃঙ্খলা এবং গু-াদের তা-ব, আগুন লাগার পর কোয়ারেন্টাইন থেকে অন্ধদের বেরিয়ে পড়া, একটি আপাত অন্ধ পৃথিবীর যন্ত্রণা ও অভিসম্পাতের নারকীয় বর্ণনা, অন্ধদের সংগঠিত হবার বাসনা এবং শ্বেত-অন্ধত্ব থেকে নগরবাসীর মুক্তিলাভ ও দৃশ্যমান পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন। অদ্ভুত দৃশ্য নির্মাণ ও অভিনব ভাবনার পাশাপাশি ‘অন্ধত্ব’ উপন্যাসের আরও একটি বিশেষত্বে দিক এর কাব্যিক ব্যঞ্জনাময় ভাষা। প্রসঙ্গত এখানে আমরা তেমন কয়েকটি অপূর্ব বর্ণনা উপস্থাপন করছি। শ্বেত-অন্ধত্বের নির্মমতাকে প্রকাশ করতে গিয়ে লেখকের বর্ণনা : ‘অন্ধত্ব ছড়িয়ে পড়ছিলো হঠাৎ বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নেয়ার মতো করে নয় বরং এক হাজার একটি অবাধ্য নদী গোপনে এগিয়ে এসে অলক্ষ্যে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে সমস্ত পৃথিবীকে সম্পূর্ণ প্লাবিত করার মতো।’ ওয়ার্ডে আগুন লেগে যাবার আগ মুহূর্তে গু-াদের অত্যধিক হর্ষ-বিনোদন সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য- ‘এসব যে খুব অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে ওদের ভ্রƒক্ষেপ ছিল না। আমরা যেন ভুলে না যাই, জীবনের সবকিছু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাদের খাবার থালা এবং ওদের দখলে ছিল আটটি খাট ও একটি পিস্তল যা ওদের পাহারা দেবেÑ এই পলকা নিশ্চয়তা, তাদের আরও কতক্ষণ হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখলো।’ কোয়ারেন্টাইনের বন্ধিত্ব থেকে মুক্তির পরও যখন অন্ধদের মধ্যে কোন তৃপ্তির প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হচ্ছিল না, সেই চরম দ্বান্দ্বিক মুহূর্তে লেখকের কলম থেকে উঠে আসে নির্মম বাস্তবতার কিছু জান্তব বাক্মন্ত্র- ‘এই অন্ধরা ভীতসন্ত্রস্ত। তারা জানে না কোথায়, কীভাবে পৌঁছুবে। ব্যাপার হচ্ছে, পথ-প্রদর্শকের সাহায্য ছাড়া, অনেকটা চামড়ার দড়িতে বেঁধে কুকুরগুলোকে যেভাবে টেনে নেয়া হয় তেমনি তাদের কেউ হাত ধরে টেনে না নিলে, এইসব অন্ধের কাছে গোলকধাঁধার মতো এই তথাকথিত মানবিক আশ্রয়কেন্দ্রের সঙ্গে মুক্ত পৃথিবীর যেন কোন তফাতই নেই।’ উপন্যাসের একটি বিশেষ চরিত্র হিসেবে আমরা একটি কুকুরের ভূমিকা লক্ষ্য করি, লেখক বারবার যাকেÑ ‘অশ্রু চাটা কুকুর’-বলে উল্লেখ করেছেন। দুটি বিপরীত মেজাজ আমরা কুকুরটি আচরণে লক্ষ্য করি। কুকুরটির সে দুটি বিশেষ স্বভাব সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য তুলে ধরছি- ‘কুকুরটি দরজা আগলে থাকল। এটি আসলে এক রূঢ় আর বদ মেজাজের জন্তু; বিশেষ করে তার মন যখন কারও অশ্রু চেটে নেবার মতো নরম অবস্থায় থাকে না।’ কুকুরটি জানত যে, একমাত্র কোন চোখ জোড়া এখনও আক্রান্ত হয়নি। সেজন্যই এটি সবসময় ডাক্তার গিন্নীর পাশে পাশে থাকত, লেখক কুকুরটির এই বিশেষ প্রীতিকে দারুণ মুন্সিয়ানায় তুলে ধরেছেন ‘যেসব কুকুর দিনে দিনে হায়েনা হয়ে উঠেছে, সে তাদের দলের নয়। সে মরা মানুষের গন্ধ শুঁকে ছুটে যায় না। সে একজোড়া চোখকে সঙ্গ দেয় যে চোখকে সে জানে জীবন্ত বলে, সুন্দর বলে।’ উপন্যাসের শেষটিও ছিল দুর্দান্ত। নগরের সবাই দৃষ্টি ফিরে পেয়ে রাস্তায় নেমে আনন্দ উদযাপন করছে, এই আত্মহারা উন্মাদনা দেখে হঠাৎ ডাক্তারগিন্নী যেন- সবকিছু সাদা দেখতে পেল। সে ভাবল, ‘এখন বোধ হয় আমার পালা।’ ভয় পেয়ে উপর থেকে সে তার চোখজোড়া নিচের দিকে নামালো এবং তাকিয়ে দেখলো ‘না! নগরটা আগের মতোই দৃশ্যমান।’ প্রত্যেক সাহিত্যাধিপতির একটি মাস্টারপিস থাকে আর নিরানন্দ ও অন্ধত্বের অন্তঃ¯্রােতে দীর্ণ ‘ব্লাইন্ডনেস’-ই জোসে সারামাগোর শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি। এ এক বিবস্ত্র আখ্যান, মারাত্মক অধঃপাত ও অভিঘাত চিত্রণে বাকরুদ্ধ করে দেয়া গ্রন্থ । সারামাগো তাঁর এ গ্রন্থে মানবতার যে অবক্ষয় ও পতনের চিত্র তুলে ধরেছেন তা এক কথায় অভাবনীয়! কতিপয় দিনকানা-অন্ধের অপরিণামদর্শিতার কারণে যে বিশ্বব্যাপী নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ, এই আখ্যান তারই পরোক্ষ পাঠ। লেখকের, দুর্বল মানুষের দুর্দশা প্রত্যক্ষণের এই অন্তর্দৃষ্টি আমাদের প্রিমো লেভির কথা মনে করিয়ে দেয়। অবর্ণনীয় পাশবিকতা ও মানবতার চরম বিপর্যয়ের কথামালায় এগুলেও কারও কাছেই গ্রন্থটি অসহনীয় কিংবা বিরক্তিকর মনে হবে না, যা ঔপন্যাসিকের বড় কৃতিত্ব। আসলে গ্রন্থটির উরপঃরড়হ সারামাগো এমনভাবে নির্মাণ করেছেন যাতে গভীর প্রচ্ছন্নতায় যুক্ত রয়েছে কৌতুক ও জীবনের বিচিত্র আস্বাদ। জোসে সারামাগো আসলে প্রতিনিধিত্বের পরিশুদ্ধতাকে মুক্তির পথ মনে করেন এবং বিচ্ছিন্নতাকে জীবনের পথে বড় প্রতিবন্ধক বলে সাব্যস্ত করেন, এই চিন্তাসূত্র ধরে গ্রন্থটি এগিয়েছে এবং একই সূত্রেই অবসান ঘটে শ্বেত-অন্ধত্বের।
×