ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বই ॥ খেয়ালি খেয়া

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

বই ॥ খেয়ালি খেয়া

কবি আসিফ নূরের ‘খেয়ালি খেয়া’ প্রকাশ পায় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায়। সমগ্র প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এস। দুই পঙ্ক্তির শৈল্পিক শৈলীতে অলঙ্কৃত ছন্দবদ্ধো এই আকর্ষণীয় কবিতা গ্রন্থটিতে আরও একটি চমকপ্রদ মাত্রা সংযোজিত হয়েছে অন্যতম বিশিষ্টতায়। অগ্রজপ্রতিম বন্ধু জ্যোতির্ময় নন্দীর ইংরেজী ভাষান্তর। আর এই অন্যমাত্রার নান্দনিক আবহ তৈরি হয়েছে একেবারে শুরু থেকেই। জ্যোতির্ময় নন্দী এই দ্বিপদী কবিতাগুলোর ভাষান্তর করতে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের কাব্য ধারায় প্রচলিত দোঁহা’র প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আবদ্ধ করেছেন। যা বাংলা সাহিত্যের কাব্যধারার এক ভিন্নমাত্রার আয়োজন। মধ্যযুগ থেকে শুরু হওয়া এই দ্বিপদী কাব্যলঙ্কারের মূল সারবত্তায় আবিষ্ট থাকত অতি প্রাকৃতিক কিংবা আধ্যাত্মবাদের এক পরম ঐশ্বরিক শুদ্ধতায়। যদিও কবি আসিফ নূর সেই অতিন্দ্রীয় দার্শনিক ভাব সম্পদ থেকে তার কবিতাকে মুক্ত করে জাগতিক চেতনায় ঋদ্ধ করেছেন। ভাবানুভূতির অদৃশ্য জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বস্তুগত দৃশ্যমান প্রতিবেশ স্পষ্ট করে কবি আধুনিক শিল্পজগতকে মহিমান্বিত করেছেন তার বাস্তব কাব্যচেতনার নান্দনিক শৌর্যে। ছোট্ট ছোট্ট দুই লাইনের কবিতা কিন্তু অর্থের ব্যাপক আর গভীরতায় যে বার্তা পাঠকের সামনে হাজির হয় তা যেমন প্রতিদিনের জীবনাচরণ একইভাবে সাহিত্যেরও এক অনুপম সম্ভার। সময়ের বিবেচনায় পাঠকের জন্যও এক সুখকর অনুভব যা মুগ্ধতার আবেশে ভরিয়ে দেয়। সুহৃদদের নিবেদন করা প্রথম দুটি পঙ্ক্তিই অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ এবং অনুভূতিপ্রবণ। তারপর থেকে শুরু হওয়া দুই লাইনের কবিতাগুলো মানব জীবনের যে গূঢ়তম পর্যায়ে অভিষিক্ত হয় সেখানে পাঠক চলে যায় এমন এক জগতে যা শুধু তার একান্ত নিজেরই। প্রতিদিনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ বেদনা, চাওয়া পাওয়া থেকে আরম্ভ করে আত্মশক্তি কিংবা আত্মদান, ব্যর্থতার অভিমান সবই সূক্ষ্ম শৈল্পিক সৃষ্টিতে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র এই দু’লাইনের ছন্দময় আবেগে নির্মোহ ভালবাসা যেমন পাঠকের হৃদয়ে ঝংকার তোলে একইভাবে হরেকরকম বৈষয়িক আবেদন নিবেদনও কবিতার মাত্রাকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। পাশাপাশি জ্যোতির্ময় নন্দীর ইংরেজী ভাষান্তর কবির আপন বৈশিষ্ট্যের এক নতুন মাত্রার অভিযাজন বললে বেশি বলা হবে না। যিনি লিখেছেন তিনি যেমন পাঠককে সীমাবদ্ধ দুই পঙ্ক্তিতে আনন্দ আবেগে ভরিয়ে তুলছেন একইভাবে যার ইংরেজী অনুলেখন কবিতাগুলোকে আর এক বিশেষ মাত্রায় নিয়ে গেছে তার ভূমিকায়ও খাটো করে দেখার কোন অবকাশ থাকে না। ছোট ছোট অনুভূতিগুলো কিভাবে বৃহৎ প্রেক্ষাপটের বার্তা হয়ে পাঠককে চমক আর মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায় তা আসিফ নুরের কবিতাগুলো প্রমাণ করে দেয়। প্রসঙ্গক্রমে ছোট্ট দু’লাইনে এসে যায় জন্মান্ধ কবি হোমারের অন্তর্দৃষ্টির প্রখরতা যা দিব্য চক্ষুকেও হার মানায়। সুখ আর দুঃখকে এমন নির্মলভাবে অনুভব করা অতি অল্পকথায় যা না পড়লে বোঝাই যাবে না। না পাওয়ার বেদনাও যে কত আপেক্ষিক আর ক্ষুদ্র তা কবি মাত্র দুটো লাইনে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। যেমনÑ তোমার নাকি জুতো নেই? আমার তো পা-ই নেই! প্রায়ই ৭৪টি ক্ষুদ্র কবিতায় সন্নিবেশিত আসিফ নুর আর জ্যোতির্ময় নন্দীর মিলিত অবগাহনে ‘খেয়ালি খেয়ার যে নান্দনিক দীপ্তি তা যেমন অভিভূত করার মতো শৈল্পিক আবেদনে নিবিষ্ট পাশাপাশি প্রতিদিনের জীবন চলার নানামাত্রিক পর্যায়েরও এক বিশুদ্ধ বার্তাবহ। মানুষের জীবন একরৈখিকভাবে কুসুমাস্তীর্ণ নয়। আনন্দ বিষাদ, ভালমন্দ, ভাঙ্গাগড়া, সঙ্কট, বিপর্যয়, শুভ আর অশুভের যে মিলনগ্রন্থি নিত্যদিনের প্রবহমান গতিময়তায় সেই জীবনবান্ধব অনুভব অনুভূতিগুলোই ছোট ভাব সম্পদে বৃহৎ আকারে উপস্থাপন করার যে মহৎ চেষ্টা তাকে আন্তরিক অভিনন্দন। নবরূপে দুই কবির এই সৃষ্ট কাব্য মহিমা কবিতার অঙ্গনকে আর এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে এই আশা ব্যক্ত করাই যায়। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
×