ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মায়াবতী ঝরনায় একদিন

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

মায়াবতী ঝরনায় একদিন

টিং টিং করে কি যেন বেজে চলছে চোখে ঘুমের ঘোর? ঘুমাতুর চোখে ঘড়ির এ্যালার্ম বন্ধ করলাম, হঠাৎ মনে হলো আমাদের তো বাইরে বের হবার কথা, মুষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে? ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না তার মাঝে খুরশেদ ভাই এর ফোন স্যার, ঘুম থেকে উঠেছেন, যাবেন না? বেশ কিছুদিন হয় কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। কোথাও যে যাব তার প্ল্যান ও করা হয়নি। কারণ,আমার প্ল্যান করে কোথাও যাওয়ার ইতিহাস খুব বিরল। বারে শুক্রবার তাই আর দেরি না করে ঝটপট ঘুম থেকে উঠে রেডি হলাম। আগের দিন আমার ব্যাংকের গ্রহক খুরসেদ আলম ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল কোথায় যাওয়ায় যায়। অফিসে কাজের খুব চাপ গিয়েছে তাই আর ঘরে বসে থাকতে মন চাইছে না। খুরশেদ ভাই বললেন, চলেন আমাদের ওখানে জাফলং এ। আমি বললাম অনেকবার গিয়েছি। উনি বললেন, গিয়েছেন ঠিক আছে কিন্তু আপনাকে জাফলং এর এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে গেলে কাজের যে চাপ গিয়েছে তা ভুলে যাবেন। আমি আর না বললাম না বেশ কিছুদিন হয় ঐ দিকে যাওয়া হয় না। সকাল ৭টা আমরা গাড়িতে চেপে বসেছি। সিলেট শহরের বন্দরবাজার হয়ে মিরাবাজার, শিবগঞ্জ, এমসি কলেজ, সরকারী কলেজ পেরিয়ে, আমরা এগিয়ে চলছি এদিকে পেটে রাম রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়েছে কারণ সকাল হতে পেটে কিছু পরেনি। খুরশেদ ভাই কে বললাম ভাই পেটে তো পেট্রোল দিতে হয়। খুরশেদ ভাই বললেন, আর একটু সামনে যাই আপনাকে স্পেশাল রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাব সেখানে এমন খাবার পাবেন যা ঢাকা তে ও খুঁজে পাবেন না। ঢাকার মানুষ এখানে আসেন খাবার খেতে। মনে মনে ভাবলাম কি আর এমন খাবার আছে যা ঢাকা তে পাওয়া যায় না আজাইরা মন ভোলানো কথা আর সামনে দিকে যখন কোন রেস্টুরেন্ট দেখি তখনই মনে হচ্ছিল কখন যে খুরশেদ ভাই এর সেই স্পেশাল রেস্টুরেন্ট আসবে। আমারা হরিপুর বাজার এ এসে পড়েছি এদিকে ক্ষুধায় বাঁধ ভাঙ্গার পথে জিজ্ঞেস করলাম আর কত দূর খুরসেদ ভাই বললেন আর দুই মিনিট। আমাদের গাড়ি থামল। দেখি মূল রাস্তা থেকে নিচে একটা খুপরি ঘর আর সঙ্গে দুটা টেবিল আর বেঞ্চ দেওয়া। আমি মনে মনে ভাবলাম এই বুঝি খুরশেদ ভাই এর স্পেশাল রেস্টুরেন্ট। খুরশেদ ভাই আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন আগে নাস্তা করেন। খাবার একবার খেলে পরে বার বার খেতে ইচ্ছা করবে। আমরা দোকানে গিয়ে বসলাম দেখলাম একজন বৃদ্ধ মহিলা কি যেন রান্না করছে আর বেশসুন্দর গন্ধ বের হয়েছে। একটু পরে আমাদের টেবিলে খাবার এসে হাজির হলো। আমরা হোটেলের সামনে ডিপ টিউবওয়েলে হাত ধুয়ে বসে পড়লাম খেতে। চালের গুড়ার রুটি আর সঙ্গে দেশী মুরগির মাংস এবং হরিপুর এর প্রখ্যাত লেবু। প্রথমে একটু খারাপ লাগছিল পরিষ্কার পরিচ্ছনতা নিয়ে পরে খাবার মুখে দিয়ে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হোল। অসাধারণ স্বাদ। দেশী মুরগির মাংস আর রান্নায় ব্যবহার করা হয়েছে বাটা মসলা আমরা সাধারণত যারা শহুরে সবাই গুঁড়া মসলার ওপর নির্ভরশীল কবে যে বাটা মসলার রান্না করা খাবার খেয়েছি তা মনেই করতে পাড়ব না। আমাদের সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা রওয়ানা দিলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। জাফলং এর কাছে পৌঁছাতেই দেখা মিলল পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে চলছে ঝর্ণা দূর থেকে তাকালে মনে হবে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে নরম তোলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি। বৃষ্টির সময় তাই পার্শ্ববর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের আকাশ ছোঁয়া খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়গুলো এ সময়ে সবুজে ভরে উঠেছে। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের এই জনপদকে। আমরা জাফলং বলাঘাট এ এসে পৌঁছালাম তার পর নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে এগিয়ে চললাম আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। নদী পার হলেই খাসিয়াপুঞ্জি। খাসিয়াদের গ্রামকে বলা হয় পুঞ্জি। এই পুঞ্জিগুলোতে গেলে দেখা যাবে ৩-৪ ফুট উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি খাসিয়াদের ঘর। প্রতিটি বাড়িতে সৃজিত পানবরজ। মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া সম্প্রদায়ের পুরুষরা গাছ বেয়ে বরজ থেকে পান পাতা সংগ্রহ করেন। আর বাড়ির উঠোনে বসে নারী সদস্যরা পান পাতা ভাঁজ করে খাঁচা ভর্তি করেন বিক্রির জন্য। পান পাতা সংগ্রহ ও খাঁচা ভর্তি করার অভিনব দৃশ্য সবারই নজরকাড়ে। আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। খুরসেদ ভাই বললেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যর উংশিং পুঞ্জির পাশ দিয়ে অঝোর ধারায় ঝরছে এই ঝরনা ধারা। যেখানে মাথার ওপর চেপে ধরা আকাশটা অনেক উঁচুতে। ছাই বরণ মেঘমালা খানিকটা পর পর রং বদলাচ্ছে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা ছুটতে চলেছে অজানা গন্তব্যের দিকে। বইছে বাতাস সঙ্গে চলছে রৌদ্র ছায়ার খেলা। সুনীল আকাশে সাদা সাদা মেঘে সূর্যের আলো ঠিকরে তৈরি করছে অপূর্ব আলোকচ্ছটা। উজ্জ্বল আলোয় ভরিয়ে থাকা দিনে মৃদু বাতাস। আমরা ঝরনার একদম কাছে গিয়ে মনের তৃষ্ণা মেটাতে থাকলাম। বেশ পর্যটক এর আনাগোনা দেখলাম আমরা। প্রকৃতির সুনিপুণ হাতের তৈরি ছায়া সুনিবিড় শান্তিময় তরুচ্ছায়া ঘন, গাঢ়, চির সবুজের পাহাড়ের বুক থেকে স্বচ্ছ জল রাশির ঝরনা ধারা ভ্রমণ পিপাসুদের মনের তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃতির আপন মহিমায় গড়ে ওঠা এই জায়গায় আসলে বোধ করি শত পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত ও বিষাদে ভরা মন প্রাণ নিমিষেই জুড়িয়ে যাবে। তবে বলে রাখা ভাল সাহস দেখিয়ে অনেকেই ঝরনার শেষ সীমানা পর্যন্ত যেতে চান যা খুব বিপজ্জনক। কারণ চারপাশে বড় বড় পাথরের বোল্ডের ওপর থেকে পড়লে বড় ধরনের অনাকক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে। ও আরেকটা কথা আমাদের পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার তাই দয়া করে পানির বোতল, প্লাস্টিকের প্যাকেট যত্রতত্র ফেলবেন না। কিভাবে যাবেন– ঢাকা থেকে বাসে/ ট্রেন এ সিলেট, ভাড়া ২৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা। সিলেট থেকে লোকাল বাসে জাফলংমামার বাজার, ভাড়া ৬০ টাকা অথবা গাড়ি রিজার্ভ করে ভাড়া নিবে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা জাফলং বল্লাঘাট থেকে ১০ টাকা দিয়ে পিয়াইন নদী পাড় হয়ে খাসিয়া পুঞ্জি সেখান থেকে রিক্সা বা শ্যালো ইঞ্জিনচালিত গাড়ি করে সংগ্রাম পুঞ্জির অপর প্রান্তে নামলেই মেঘালয় পাহাড় দেখতে পাবেন। সেখান থেকে হেঁটে আধা কিলোমিটার হাঁটলেই শুনতে পাবেন ঝর্ণার গর্জন, দেখতে পাবেন মায়াবী ঝর্ণার হাতছানি। অথবা জাফলং বলাঘাট থেকে টুরিস্ট নৌকা করে যেতে পারেন। ইতোমধ্যে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ভিড় করছেন এই ঝর্ণায়। [email protected]
×