ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমায় সব তছনছ

বকুল দেবনাথের পরিবারে আজও কান্না থামেনি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

বকুল দেবনাথের পরিবারে আজও কান্না থামেনি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আজও কান্না থামেনি বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের পেট্রোলবোমায় নিহত বকুল দেবনাথের পরিবারে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে দিশেহারা পরিবারটি। বকুল দেবনাথের মৃত্যুর পর অভাব সেই কান্না আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই কান্না দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে বকুল দেবনাথের আড়াই বছরের মেয়ের জন্য। প্রায়ই মেয়ে আব্বা আব্বা বলে ডাকে। এ সময় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নেমে আসে গভীর বিষাদের ছায়া। বকুল দেবনাথের কথা মনে করে পরিবারের সবাই অঝোরে কাঁদেন। মেয়ে রাঁখি রানী নাথের পিতাকে দেখার স্বপ্ন চিরতরে ভেঙ্গে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের পেট্রোলবোমা। বকুল দেবনাথের পরিবারের আশা এমন নৃশংস হত্যাকা-ের যেন বিচার হয়। বকুল দেবনাথের (৩৫) পিতার নাম স্বর্গীয় রতন মনি নাথ। মা স্বর্গীয় ফুল রানী নাথ। বাড়ি সিলেট জেলার ওসমানীনগর থানাধীন গোয়ালাবাজারের শসারকান্দি গ্রামে। দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই রিন্টু দেবনাথ একটি সবজি দোকানের ম্যানেজার। একমাত্র বোন লাভলী রানী নাথ। লাভলীর স্বামী কৌশিক চন্দ্র নাথ বলছিলেন, তার শ্বশুরের পরিবার সত্যিকার অর্থেই অভাবী। থাকার মধ্যে তিন ডেসিমেল জমির ওপর বাড়ি ভিটা রয়েছে। আবাদি কোন জমি নেই। দাদা ট্রাক চালাতেন। ওই সময় বিএনপি-জামায়াত-শিবির আন্দোলনের নামে প্রচ- তা-ব চালাচ্ছিল। অভাবের সংসারে নিরুপায় হয়ে দাদা ওই সময় বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের প্রচ- তা-বের মধ্যেই ট্রাক নিয়ে বের হন। এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। কারণ তার স্ত্রী নিলীমা রানী নাথ তখন গর্ভবতী। সংসারে নিলয় দেবনাথ নামের চার বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। রোজগার করা ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। তাই প্রচ- ঝুঁকি নিয়েই তিনি ট্রাক চালাতে বের হয়েছিলেন। কারণ ট্রাক না চালালে দিন হাজিরার টাকা পাবেন না। সংসার চলবে না। কিন্তু সব তছনছ হয়ে গেল একটি পেট্রোলবোমায়। ঘটনার দিনটি ছিল ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি। দাদা ট্রাক নিয়ে সিলেটের তামাবিল থেকে আসছিলেন। ট্রাকটি তামাবিল রোডের বাঘের সড়ক এলাকায় পৌঁছার পর ঘটে যায় সেই হৃদয় বিদারক ঘটনা। তখন রাত প্রায় পৌনে তিনটা। বিএনপি-জামায়াত-শিবির ঘন ঘন ওই এলাকায় ওই সময় প্রতিদিনই মিছিল করছিল। আচমকা রাস্তার পাশ থেকে একটি পেট্রোলবোমা ট্রাকে ছুড়ে মারা হয়। ভারি কাঁচের বোতলে তৈরি সেই পেট্রোলবোমা দাদার গায়ে গিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। দাদা কোনমতে গড়াতে গড়াতে গাড়ি থেকে পড়ে যান। কিন্তু আগুন নেভাতে পারেননি। পেট্রোল গায়ে মেখে যায়। এজন্য আগুন নেভাতে পারেননি তিনি। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়। তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দিন দিন অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাকে সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২২ জানুয়ারি ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। সরকারী খরচে তার চিকিৎসা চলে। অনেক চেষ্টার পরও তাকে বাঁচাতে পারেননি চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দায়িত্বরত চিকিৎসকদের ফিরিস্তি মোতাবেক বকুল দেবনাথের মাথা, শ্বাসনালী, শরীরসহ অনেকাংশই মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়। তার শরীরের ৩৫ ভাগ দগ্ধ হয়েছিল। তার শ্বাসনালী মারাত্মকভাবে পুড়ে যাওয়ার ফলে কোন চিকিৎসাই কাজে আসেনি। হাসপাতালে দিন দিন অবস্থার অবনতি হতে থাকে। দাদার চিৎকারে কেউ ঘুমাতে পারেনি। সারা শরীরে যন্ত্রণা। সেই দৃশ্য চোখে দেখার মতো নয়। মানুষ একজন মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে, তা চোখে না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন। প্রায় এক সপ্তাহ মৃত্যু যন্ত্রণায় চিৎকার করেন দাদা। শেষ পর্যন্ত চিৎকার করতে করতেই ২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি সবাইকে ফেলে স্বর্গে চলে যান। তার মৃত্যুর পর সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে তার পরিবার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর পর অভাব যেন গিলে খাচ্ছে পরিবারটিকে। সরকারের দেয়া ১০ লাখ টাকা ব্যাংকে রাখা হয়েছে। সেই টাকায় মাসিক যে টাকা পায়, সেই টাকা দিয়ে কোনমতে সংসার চলে। ছেলেকে স্কুলে দিতে হয়েছে। দাদা চলে যাওয়ার পর জন্ম নেয় মেয়ে রাঁখি রানী নাথ। এখন রাঁখির বয়স প্রায় আড়াই বছর। প্রায়ই আব্বা আব্বা করে ডাকে। তখন আর চোখের জল ধরে রাখা যায় না। জন্মের পর আর পিতাকে দেখা হলো না রাঁখির। অবুঝ শিশুটির পিতা দেখার স্বপ্ন আর কোনদিনই পূরণ হলো। জন্মের আগেই বিএনপি-জামায়াত-শিবির তার পিতাকে কেড়ে নিল। এ দুঃখ কোন দিনই ভুলার নয়। নিজেদের সংসার রয়েছে। আমাদের সংসারেই টানাটানি। তার মধ্যে দাদার সংসারে অর্থের যোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও সবাই মিলে সহায়তা করে দাদার সংসার টিকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। দাদাকে হত্যা করে যারা একটি পরিবারকে নিষ্ঠুর বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিল, আমরা দাদাকে হত্যাকারী বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের সেই পেট্রোল বোমাবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চাই।
×