ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কিভাবে চলছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কিভাবে চলছে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলো কী শেখাচ্ছে? কারা শিক্ষক, পরিচালনাইবা কারা করছেন, কত টিউশন ফি? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানে না কোন মন্ত্রণালয় ও সরকারের কোন সংস্থাই। অথচ এখানে যারা পড়াশোনা করছে তাদের শতকরা ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। সরকার যত বিধিবিধান আর গেজেটই জারী করুক না কেন কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না এসব প্রতিষ্ঠানকে। তবে বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত কয়েকটি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার উদ্বেগজনক তথ্য আসার প্রেক্ষাপটে এবার নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সূত্র বলছে, লাগামহীন শিক্ষা বাণিজ্য, দেশীয় শিক্ষাক্রমের অনুপস্থিতি আর উগ্রবাদী তৎপরতার অভিযোগের পর অবশেষে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বাগে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নির্দেশনা অনুসারে কাজও শুরু করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। জানা গেছে, মাউশি ইতোমধ্যেই দুটি বৈঠক করেছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার একটি বৈঠকে উপস্থিত থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন এইচ টি ইমাম। যেখানে মাউশির মহাপরিচালক ও পরিচালক ছাড়াও অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রধান এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সরকার এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য আসলে কি করতে চায়? মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলছিলেন, ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলো কি শেখাচ্ছে? কারা শিক্ষক, পরিচালনাইবা কারা করছেন, কত টিউশন ফি? আসলে আমরা তো সেভাবে এসব বিষয় দেখার উদ্যোগও এতদিন নেইনি। একদিন উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম স্যার হঠাৎ কল করে বললেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো কিভাবে চলছে? নীতিমালার অবস্থা কি? আমি বললাম, সেভাবে আমরা আসলে তাদের তদারকির শক্ত কোন উদ্যোগ নেইনি। তারা তো বলেনি তারা সরকারের নিয়ম অনুসারে চলবে না। স্যারের নির্দেশ অনুসারে আমি তাদের ডেকেছিলাম। দুটি সমিতির প্রতিনিধিও ছিলেন। আমরা চাই এসব প্রতিষ্ঠানকে সেভাবে চালাতে যা আমাদের দেশের স্বার্থে চলবে। কারিকুলামে আমাদের দেশের বিষয় থাকবে, তারা নিবন্ধন করবে, তারা জাতীয় সংগীত গাইবে। এখন তারা সেটা মানে বলে বলছেন। তবে সরকারী নিয়ম মেনে চলতে হবে তাদের। এজন্য ইংলিশ মিডিয়ামের জন্য নীতিমালা করা হবে বলেও জানান মহাপরিচালক। কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিমালা করার আগেই এখন থেকে বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো নিয়মিত মনিটরিং করার উদ্যোগ নিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। স্কুলগুলোকে বাংলাদেশের মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মহাপরিচালক বলছেন, দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা আধুুনিকায়ন করা হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার মানোন্নয়ন হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার আয়তন বাড়ছে। আমরা চাই ইংলিশ মিডিয়াম আমাদের দেশের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হোক। মাউশির পরিচালক (স্কুল) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বলেন, মূলত সরকারের সঙ্গে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর প্রশাসনিক সমন্বয় স্থাপনের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্কুল প্রধানদের জন্য বৈঠক করা হয়েছে। স্কুল প্রতিনিধিরাও চান সরকারের সঙ্গে তাদের সমন্বয় তৈরি হোক। শীঘ্রই তাদের সঙ্গে আরও একটি ওয়ার্কশপ করা হবে। সেখানেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তিনি আরও বলেন, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী অর্জন করা শিক্ষার্থীরা যাতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম নির্দেশনা দিয়েছেন। জানা গেছে, সভায় স্কুল পরিচালনার গেজেট, বিধিবিধান, সিলেবাস, কারিকুলাম, পরিচালনা পর্ষদ ও নীতি-নৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে সরকারকে জানানো হয়েছে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নির্দিষ্ট কারিকুলামের বাইরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস ও বাংলা ভাষার পাঠ্যবই পড়ানো হয়। ছাত্রছাত্রীদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখানো হয়, জঙ্গীবাদবিরোধী কোন কর্মকাণ্ড পরিচালনা হয় না। দেশের সব জাতীয় দিবস উদযাপন করা হয় জানিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদসহ নানা অপকর্মের কুফল সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নির্দেশের অংশ হিসেবে সব ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে সততা স্টোর চালু করা হয়েছে; অনেক প্রতিষ্ঠানে যাতে নতুন প্রজন্ম সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে এবং অল্প বয়স থেকেই দুর্নীতিবিরোধী নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়। কোন বিক্রেতা ছাড়াই সততা স্টোর থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় বই, খাতা, পেন্সিল কিনছেন। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের পছন্দমতো প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ক্যাশ বাক্সে দাম রেখে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা একে ভাল উদ্যোগ বলে স্বাগত জানিয়েছেন, দাবি করেছেন স্কুল প্রধানরা। মাউশি বলছে, রাজধানীর অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এই উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। এর মধ্যে আছে স্কলাস্টিকা, ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড স্কুল, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ, জন ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, অ্যাপল ট্রি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কানাডিয়ান টিলিনিয়াম স্কুল, সেন্ট মেরি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, রিভারভিউ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, অস্ট্রেলিয়ান স্কুল, গ্রিন ডেল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সাউথ পয়েন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজ, সেন্ট পিটার্স স্কুল অব লন্ডন, ব্রিটিশ আমেরিকান কলেজ, ব্রিটিশ কলোম্বিয়া স্কুল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, গ্রিনফিল্ড স্কুল, লরেটো স্কুল এবং লাইসিয়াম ইন্টারন্যাশনাল স্কুলসহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠান। এদিকে শীঘ্রই কার্যকর হতে যাচ্ছে বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত নতুন ইংরেজী মাধ্যম স্কুল নিবন্ধন বিধিমালা। ‘ইংরেজী মাধ্যম স্কুল নিবন্ধন বিধিমালা-২০১৭’ অনুসারে দেশের ইংরেজী মাধ্যম স্কুলকে সরকারী নিবন্ধনের আওতায় আনার কাজ শুরু করেছে শিক্ষা বোর্ড এবং মাউশি। উচ্চ আদালতের আদেশ ও বিভিন্ন মহলের দাবি অনুসারে স্কুলের বেতন ফিও নির্ধারণে আনা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রায় চার বছর ধরে আটকে ছিল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিধিমালা প্রণয়ন কাজ। নীতিমালা না থাকায় বছরের পর বছর ধরে ফ্রি স্টাইলে চলছে স্কুলগুলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলাদের গাফিলতির কারণে এতদিন এ স্কুলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না শিক্ষা বোর্ডগুলো। চার বছর আগে একবার শিক্ষা বোর্ডগুলো অবৈধভাবে পরিচালিত হওয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল এসব স্কুলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা। দেশে পরিচালিত ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের জন্য একটি পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে ২০১২ সালে উচ্চ আদালত নির্দেশনাও দিয়েছিল। সে অনুযায়ী ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমাও দিয়েছিল। এরপরও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের কর্মকর্তারা এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। এসব স্কুলের জন্য একটি পৃথক বিধিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে গত বছর উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছিল। সে অনুযায়ী ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল। তারপর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বিশেষ উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে বিধিমালা। খসড়া প্রণয়নের পর মতামতও নেয়া হয় বিভিন্নজনের। এক পর্যায়ে বিধিমালা চূড়ান্ত হয়। গত মাসে আদালতের আদেশ অনুসারেই বিধিমালা চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ইংরেজী মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও কিছু আমলার কারসাজিতে বিধিমালা কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ ওঠে। শির্ক্ষ্থাী ও অভিভাবকরা এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন। অবশেষে প্রজ্ঞাপন অনুসারে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয় বার্তা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা গেছে বিধিমালা বাস্তবায়নকারী মূল সংস্থা শিক্ষা বোর্ডের কাছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মঈনুল হোসেন বলছিলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। এখন সকলকে নিবন্ধন করতেই হবে। সকল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। যারা ২০০৭ সালের বিধিমালা অনুসারে নিবন্ধন করেনি তাদের নতুন বিধিমালা অনুসারে নিবন্ধিত হতে হবে। নতুন বিধিমালায় সরকারী তদারকি বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সব সময় মনিটরিং করব। কিভাবে প্রতিষ্ঠান চলছে। তাদেরও নিয়মিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে দিতে হবে। বর্তমানে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সাময়িক নিবন্ধনপ্রাপ্ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল একশ’রও কম। তবে ২০১১ সালের তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বেনবেইস) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সারাদেশে তিন ক্যাটাগরিতে ১৫৯ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ‘ও’ লেভেল ৬৪ এবং ‘এ’ লেভেল স্কুল ৫৪ এবং জুনিয়র লেভেলের আন্তর্জাতিক মানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে ৪১। এই মুহূর্তে কত প্রতিষ্ঠান আছে তা জানা নেই সরকার কিংবা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানেরও। বোর্ড বলছে, যদি কেউ সাময়িক নিবন্ধনের জন্য আসে তবে সেই প্রতিষ্ঠানেরই হিসাব থাকে তাদের কাছে। অন্যদের কোন হিসাব নেই বোর্ড, মন্ত্রণালয় কারো কাছেই। দু’একটি ছাড়া সাময়িক নিবন্ধনপ্রাপ্ত বাকি সব স্কুলই সাময়িক অনুমোদনের শর্ত যথাযথভাবে মানছে না। উন্নত শিক্ষা বিস্তারের নামে এসব প্রতিষ্ঠান বেপরোয়া শিক্ষা বাণিজ্যে লিপ্ত।
×