ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘের দুর্বলতার কারণ অযৌক্তিক ভেটো

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

জাতিসংঘের দুর্বলতার কারণ অযৌক্তিক ভেটো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয়ের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত ইউরোপের সব দেশ, সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন স্বৈরাচারী সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে বিশ্বকে সুরক্ষিত করতে সব জাতির অংশগ্রহণে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রয়োজন অনুভব করে। যেটি আক্রান্ত যে কোন জাতি-রাষ্ট্রের সমর্থনে নানাভাবে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। এই ধারণা থেকে প্রথমে লীগ অব ন্যাশনস্, পরে জাতিসংঘ গঠিত হয়। যার প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত। ক্রমে ক্রমে প্রয়োজন অনুযায়ী এটির গঠনতন্ত্রে সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থ্যা, বাস্তুচ্যুত গোষ্ঠীর সেবা ও প্রত্যাবাসন সংস্থা গঠিত হয়। বিশ্বমানবতা প্রথম জার্মান জাতির নাৎসি নেতা হিটলারের দ্বারা ভিন্ন ধর্ম ও জাতি-গোষ্ঠীর তথা ইহুদী নিধনযজ্ঞ দেখে বিস্মিত, হতভম্ব হয়। শুধু ধর্ম, ভাষা, জাতির ভিন্নতার জন্য মানবতার প্রতি আক্রমণ এবং আক্রান্ত মানবগোষ্ঠীর সুরক্ষা দানকে অগ্রগণ্য বিষয় বিবেচনা করা শুরু করে। এ সময় মানবাধিকার, সব রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকার এবং আরও পরে শিশুর অধিকার, নারীর মুক্তি ও ক্ষমতায়ন ইস্যুগুলো মানবসভ্যতার প্রধান নির্ণায়ক সূচক হিসেবে প্রণীত হয়, যা সব সদস্য দেশ মানতে বাধ্য থাকবে। বর্তমানে যে দুটি ক্ষেত্রে জাতিসংঘ বিশ্বের জনগণের স্বার্থে সক্রিয় রয়েছে তার একটি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে ধর্ম, ভাষা, উপজাতিতে সংঘর্ষের ফলে বাস্তুচ্যুত সাধারণ মানুষকে খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবাসহ মৌলিক অধিকার প্রদানের চেষ্টা। অপরটি হচ্ছে ওই সব সংঘাত, সংঘর্ষ, যুদ্ধাবস্থা প্রশমনে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র থেকে সেনা ও পুলিশ সদস্য সংগ্রহ করে আক্রান্ত স্থানে শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে শান্তিবাহিনী নিয়োগ। বর্তমানে বিশ্বের অনেক সংঘাতময় দেশে শান্তিবাহিনী শান্তি রক্ষার কাজ করছে, যাতে বাংলাদেশের সেনা, পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। জাতিসংঘ অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় দেশের হাতে শক্তিহীন হয়ে পড়ে, যেমনটি এবারের মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক তাদের স্বদেশী নাগরিক মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর শুধু যে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও নারীধর্ষণ করেছে তা নয়, বরং পাঁচ ’শ বছরেরও বেশি আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে তাদের রাষ্ট্রহীন করেছে! ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গাদের পাঁচ শ’ বছর আগে থেকে আরাকানে (বর্তমানে রাখাইনে) তিন-চার প্রজন্ম ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রমাণ আছে। রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে সুচি সরকার কর্তৃক নিয়োজিত কোফি আনান কমিশন যেদিন তার প্রতিবেদন সরকারকে জমা দেয়, পরদিন রাতেই পঁচিশটির মতো বর্মী পুলিশ ও সেনা চৌকিতে রোহিঙ্গা জঙ্গীরা হামলা চালিয়ে বেশকিছু পুলিশ ও সেনাসদস্য হত্যা করে। এর পরপরই শুরু হয়েছে বর্মী সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা বসতি, গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুট। এই প্রেক্ষিতে শুরু হয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশুর নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণ। মিয়ানমারে দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে চলে আসা সামরিক জান্তা সরকারের শাসনকালে মিয়ানমার বিশ্ব থেকে বিছিন্ন ছিল। দেশটি দীর্ঘকাল তার কঠিন গণতন্ত্র বিরোধিতার কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনরত আউং সান সুচিকে গৃহবন্দী করে রেখে সমালোচিত হয়। এর মধ্যেই মাঝে মাঝে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, তাদের বাস্তুচ্যুতকরণ চলছিল। যে নির্যাতনের ফলে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা আগে থেকেই কক্সবাজার এলাকায় বসবাস করছে। এ বছর ২৫ আগস্ট থেকে এই গণহত্যা তীব্র রূপ ধারণ করে, যেখানে জাতিসংঘের ত্রাণ, স্বাস্থ্যসেবা এখনও মিয়ানমার সেনারা পৌঁছাতে দিচ্ছে না। এ কারণে ২৫ আগস্টে রাখাইনে যে নিষ্ঠুর বর্বরতা শুরু হয়েছে তাতে ছয় থেকে আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। শোনা যাচ্ছে, বর্তমানে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ না হলেও খাদ্য, পানি, জীবিকার অভাবে রোহিঙ্গারা রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে উপরোক্ত পটভূমিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ চীন ও রাশিয়ার প্রবল বিরোধিতার মুখে কোন কার্যকর প্রস্তাব গ্রহণে অক্ষম থাকছে। এ ঘটনাই প্রমাণ করে জাতিসংঘের অনেক নিয়মের সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে, যার একটি হচ্ছে ‘ভেটো ক্ষমতা’। একটি রাষ্ট্রের ভেটো অন্য সদস্যদের প্রস্তাবকে বাতিল করে দেয়ার অন্যায় ক্ষমতা। এখানে স্মরণ করতে চাই, ৭১-এ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সোভিয়েত রাশিয়ার ভেটো প্রয়োগ আমাদের দেশকে স্বাধীন করতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে যে, নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা কি ভিকটিমকে সুরক্ষা দিতে প্রণীত হয়নি? এই ভেটো যদি গণহত্যাকারীর পক্ষে ব্যবহার হতে পারে তাহলে গণহত্যার শিকার রাষ্ট্র, দেশ, জাতি, গোষ্ঠী কার কাছে ন্যায়বিচার ও সুরক্ষা পাবে? সুতরাং নিয়মটি হতে হবে ‘ভেটো’ কেবল গণত্যার শিকার বা আক্রান্তের পক্ষে ব্যবহার করা যাবে, গণহত্যাকারী বা আক্রমণকারীর পক্ষে নয়। ‘ভেটো’ সংস্কারের যুক্তি হচ্ছে ১. জাতিসংঘ গঠন হয়েছিল দেশে দেশে অন্যায় যুদ্ধ, সংঘর্ষ, দাঙ্গা নির্মূলের মতো অন্যায় কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করে ওই সব দেশে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ২. জাতিসংঘ, তার কোন অঙ্গ সংগঠন আর যাই হোক কোন সময় কোন কারণে হামলাকারী, আক্রমণকারী, গণহত্যাকারীর পক্ষে অবস্থান নিতে পারে না। চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের হামলাকারী সেনাবাহিনী ও সরকার অর্থাৎ গণহত্যাকারীর পক্ষ গ্রহণের মাধ্যমে তারা মানবসভ্যতা এবং গণতন্ত্রকে উপহাস করেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে গণহত্যাকারীর নিরাপত্তাদানকারী সংস্থায় পরিণত করে হাস্যাস্পদ করে তুলেছে, যা জাতিসংঘের মূল লক্ষ্যের পরিপন্থী। ৩. জাতিসংঘকে এই সময়ে সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরী। কেননা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের ‘ভেটো’ ক্ষমতাটি এখন দুর্বলের বিরুদ্ধে, সবলের পক্ষে ব্যবহার হচ্ছে, যা পৃথিবীর সুশীল সমাজের মানবিক প্রত্যাশাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। আমার সংস্কার প্রস্তাবটি হচ্ছে * জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি, অন্তত ভারত, জাপান, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। * ‘ভেটো’ ক্ষমতা রাখার যৌক্তিকতা আলোচনা করতে হবে। যদি রাখা হয় তাহলে তা ব্যবহার হতে পারবে শুধু আক্রান্ত, হামলা ও গণহত্যার শিকারের পক্ষে, গণহত্যাকারীর পক্ষে এটি কখনও ব্যবহার হতে পারবে না। * ‘ভেটো’ ক্ষমতা বাতিল করে গণতান্ত্রিক রীতিতে মেজরিটি ভোটে ক্ষতিগ্রস্ত, হামলার শিকারকে নিরাপত্তা দেয়া সহজতর হবে, যা জাতিসংঘের মূল লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রীতি হবে। * সব রাষ্ট্রে, দেশে সেনা শাসন নিষিদ্ধ করতে হবে। * গণহত্যাকারী, হামলাকারীকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে, যেটি সাধারণ পরিষদে মেজরিটি ভোটে গৃহীত হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×