ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশী কোম্পানির দখলে চলে যাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

বিদেশী কোম্পানির দখলে চলে যাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প

রহিম শেখ ॥ দেশে যে কয়েকটি শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যবসায় নিয়োজিত বিদেশী কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্যে বিপাকে পড়েছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে ৭টি বিদেশী কোম্পানি সরকারের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যবসা করছে। কিন্তু এই সাতটি বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে কিংবা কী পরিমাণ লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারবে তার সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। ফলে বিদেশী কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাজার দখলের কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজার হারাচ্ছে। পাশাপাশি পোল্ট্রি শিল্পে ব্যাংক ঋণ সুবিধা থাকলেও সেই সুবিধা পাচ্ছে কেবল বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর ঋণ সুবিধা না পেয়ে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) বলছে, বাংলাদেশের পোল্ট্রি ব্যবসার ৪০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিদেশী ৭টি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বিদেশী সাতটি কোম্পানি হলো ভিএইচ গ্রুপ, গোদরেজ, সেগুনা, টাটা, অমৃত গ্রুপ, সিপি এবং নিউ হোপ। কোম্পানিগুলোর কেউ বাচ্চা উৎপাদন, ডিম উৎপাদন কিংবা মুরগি উৎপাদনের অনুমতি নিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিদেশী কোম্পানিগুলো বর্তমানে সবই করছে। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজার হারাচ্ছে। এছাড়া বিদেশী কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ কী পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে পারবে, মোট লভ্যাংশের কত শতাংশ নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবে এবং কত শতাংশ এদেশে খরচ কিংবা বিনিয়োগ করতে পারবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। বিদেশী পুঁজি আসার কারণে দেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা চলছে। বড় পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র খামারিরা। এসব সঙ্কটে ২০২১ সালের মধ্যে বিনিয়োগের লক্ষ্য অর্জন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দাম পাচ্ছে না ছোট খামারিরা ॥ পোল্ট্রির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ হলো একদিন বয়সী বাচ্চা এবং পোল্ট্রি খাবার। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এ সংক্রান্ত নীতিমালা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বর্তমানে বাজারে ব্রয়লার মুরগির একদিনের বাচ্চার দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা। আর লেয়ারের বাচ্চা খামারিদের কিনতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। অথচ এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ব্রয়লারের একদিনের বাচ্চার উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। লেয়ারের বাচ্চার উৎপাদন খরচও ৩৫ টাকার কাছাকাছি। অথচ তা বাজারে বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিন গুণ দামে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক এসএম সোহরাব হোসেন বলেন, এ শিল্পটি অভিভাবকহীন। নানা সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। কোন নিয়ম-নীতি না থাকায় এ খাতের বড় কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র খামারিরা। তিনি বলেন, একদিনের লেয়ার মুরগির বাচ্চা ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কিনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক ফায়েজ রাজা চৌধুরী বলেন, এ খাতের বড় কোম্পানিগুলোর কাছে আমরা ছোট খামারিরা রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছি। একদিনের ব্রয়লার বাচ্চা কিনতে হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৬ টাকায়। এই বাচ্চাকে এক কেজি থেকে এক কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের বানাতে ৩৫ থেকে ৪০ টাকার খাবার খাওয়াতে হয়। কিন্তু এই ওজনের একটি মুরগি আমরা বিক্রি করছি ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। আমরা মুনাফা তো দূরের কথা মুরগি বিক্রি করে লোকসান গুনছি। এগ প্রডিউসারস্ এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন বলেন, দেশের কিছু বড় কোম্পানি ও বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে পোল্ট্রি ব্যবসা। আমরা ক্ষুদ্র খামারিরা এখন কোণঠাসা। তিনি বলেন, আমরা প্রতি পিস সাদা ডিম বিক্রি করছি ৫ টাকা ২০ পয়সায়। তাহলে কিভাবে আমরা টিকে থকব। সরকার যদি ক্ষুদ্র খামারিদের প্রতি নজর না দেয় তাহলে পোল্ট্রি শিল্পে ক্ষুদ্র খামারিরা টিকে থাকতে পারবে না। অগ্রিম আয়করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ॥ তথ্য অনুযায়ী, পোল্ট্রি উৎপাদনে যে খরচ হয় তার ৬৮ শতাংশ খাদ্য খরচ, ১৮.৫ শতাংশ বাচ্চা কেনার খরচ, ৫ শতাংশ ওষুধের খরচ, ৪ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি এবং বাকি অন্যান্য খরচ। বর্তমানে এসব খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সারাবিশ্বে পোল্ট্রি খাদ্যের অন্যতম উপকরণ ভুট্টার উৎপাদন কমায় দাম বেড়েছে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় ভুট্টার ৪০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। এর ওপর আবার বসানো হয়েছে অগ্রিম আয়কর, যার কারণে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামাল সয়াবিন মিল ও ওয়েল কেকের ওপর যথাক্রমে ১০ ও ৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পোল্ট্রি খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা জানান, দীর্ঘদিন যাবত পোল্ট্রি শিল্পের আয় করমুক্ত ছিল। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে এ শিল্পের কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। চলতি অর্থবছরেও তা অব্যাহত আছে। অসম প্রতিযোগিতায় খামারিরা ॥ বর্তমানে দেশে পোল্ট্রি শিল্পে ৭টি বিদেশী কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে ৫টি ভারতের, ১টি থাইল্যান্ডের ও ১টি চীনের। এগুলো দেশের পোল্ট্রি শিল্পের প্রায় ৩০ ভাগ পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছে দেশী খামারগুলোর। বিদেশী অর্থপুষ্ট খামারগুলো বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে আসছে ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদে। অথচ আমাদের খামারগুলোকে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। এমনকি বিদেশী খামারগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে স্থানীয় বড় খামারগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। ঝরে পড়ছে ছোট খামারগুলো। বর্তমানে কৃষি খাতে মসলা ফসল চাষের জন্য ৪ শতাংশ সুদে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ দেয়া হচ্ছে। দুগ্ধ খামার গড়ে তোলার জন্য পশু কিনতে ঋণ দেয়া হচ্ছে ৫ শতাংশ হারে। যশোরের কড়িয়াখালী গ্রামের মনসুর আলী বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে খামার দিয়েছিলাম। কিন্তু ভ্যাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেটা বেশি দিন টিকে থাকেনি। মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা ও এনজিও থেকে লোন নিয়েছিলাম। কিন্তু বছর না পেরুতেই খামার বন্ধ করে দিয়ে কাঁচামালের ব্যবসা করছি। আরেক ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দীন বলেন, আমার আগে পোল্ট্রি খামার ছিল। কিন্তু ব্যাংকে বিভিন্ন সময় আবেদন করেও ঋণ পাইনি। যার কারণে ডিলারদের কাছ থেকে বাকিতে মুরগির বাচ্চা, খাবার ও মেডিসিন কিনতে হয়েছে। এভাবে যশোর অঞ্চলের অধিকাংশ ক্ষুদ্র খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, পোল্ট্রি শিল্পে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ সুবিধা থাকলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা কোন ঋণ সুবিধা পায় না। তাদের ঋণ সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি খাতা কলমেই সীমাবদ্ধ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, পোল্ট্রি শিল্পে ব্যাংক ঋণের সুবিধা আছে। কোন খামারি এ সুবিধা পান না বলে জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা যেন ঋণ সুবিধা পান সে ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানান।
×