ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার সব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতি নেবেন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার সব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতি নেবেন

আরাফাত মুন্না ॥ প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেয়া পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ গ্রহণের পর তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোন প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি করেনি সরকার। এদিকে আইন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের পর নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়ার কোন সময় সংবিধানে বেঁধে না দেয়ার সব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতিই নেবেন। তাই তারা বঙ্গভবনের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। রাষ্ট্রপতি নতুন কাউকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব না দেয়া পর্যন্ত বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিই ওই দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার আগেই নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। তবে এবার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮২ দিন আগে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত ১১ অপরাধ মাথায় নিয়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে বসে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা নিয়ে অভাবিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সংবিধানে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য ঘোষণা করার তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। এক. ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ হলে। দুই. অপসারিত হলে এবং তিন. পদত্যাগের মাধ্যমে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল থাকা অবস্থায় পদত্যাগের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। ওই রায়ে বর্তমান (পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী) সংবিধানের ৯৬ (৮) অনুচ্ছেদে বর্ণিত দফাটি বাতিল করা হয়েছে। ৯৬ (৮) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারবেন।’ এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমাদের সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি যতক্ষণ পর্যন্ত নিযুক্ত না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে আপীল বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতিকে নিয়োগ দিতে পারেন, এবং তিনি প্রধান বিচারপতির যা করণীয় সেটা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে এখন যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন, তিনি ওই দায়িত্ব পালন করবেন, যতক্ষণ না রাষ্ট্রপতি নতুন প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগ করায় কত দিনের মধ্যে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, সংবিধানে এমন কিছু লেখা নেই। রাষ্ট্রপতির হাতে সময় আছে, উনি করবেন। আর কত দিনের মধ্যে নিয়োগ করবেন সেটা দেশের আইনমন্ত্রী জবাব দিতে পারবে না। প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য ঘোষণা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন কবে জারি করা হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জাহিরুল হক দুলাল জনকণ্ঠকে বলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি গ্রহণের পর আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির নির্দেশ পেলেই আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য ঘোষণার প্রক্রিয়া কি হবে তা একমাত্র রাষ্ট্রপতিই ভাল জানেন বলে জানিয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, নতুন প্রধান বিচারপতির নিয়োগের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। দুটি বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সম্পূর্ণ এখতিয়ার। এক হলো প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, অপরটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা। কাজেই রাষ্ট্রপতি যখনই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন তখন সবাই দেখবেন, আমিও দেখব। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এক মাসের ছুটিতে যান। এরপর ছুটি আরও ১০ দিন বাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া যান তিনি। গত শুক্রবার রাতে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠিয়ে সেখান থেকে টরন্টোয় চলে যান সিনহা। ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর তার আয়কর রিটার্নে অসঙ্গতি ও ব্যাংক এ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় বিতর্কের মুখে পড়েন তিনি। এসব বিষয়ে সিনহার পদত্যাগের দাবিও ওঠে বিভিন্ন মহলে। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ছুটিতে গেলেও গত ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সময় লিখিত বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি সিনহা বলেছিলেন, তিনি সুস্থ আছেন। সাময়িকভাবে যাচ্ছে। আবার ফিরবেন। প্রধান বিচারপতি বিদেশে যাওয়ার পরদিন ১৪ অক্টোবর সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে বিভ্রান্তিমূলক উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে থাকা ১১ অভিযোগেরে কথা জানানো হয়। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে এর আগে সুপ্রীমকোর্টের তরফ থেকে কোন ধরনের বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করা হয়নি। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিবৃতিটি দেয়া হলো। সুপ্রীমকোর্টের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপীল বিভাগের বিচারপতিরা। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুপ্রীমকোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ আগস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে ছুটিতে যান। রাষ্ট্রপতি বরাবরে প্রধান বিচারপতির পাঠানো সেই ছুটির আবেদন সাংবাদিকদেরও দেখান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সেখানে বলা ছিল, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এর আগে তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং বেশ কিছুদিন ধরে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্রামের জন্য ৩ অক্টোবর থেকে ১ নবেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিন তিনি ছুটি কাটাতে চান। এর মধ্যে গত ৭ অক্টোবর বিচারপতি সিনহার অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পাওয়ার খবর আসে। আদালতের একটি সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতি ও তার স্ত্রী সুষমা সিনহা তিন বছরের ভিসা পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বড় মেয়ে সূচনা সিনহার কাছে উঠবেন তারা। এরপর বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা রাষ্ট্রপতিকে জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন বিচারপতি সিনহা। আইন সচিব সেদিন জানান, ১৩ অক্টোবরে থেকে ১০ নবেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার ইচ্ছার কথা ওই চিঠিতে রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। চলতি বছর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের এই সংশোধন এনেছিল বর্তমান সরকার। হাইকোর্ট ওই সংশোধন বাতিলের পর আপীল বিভাগও একই রায় দেয়। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সংসদ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে খাটো করেছেন বলে অভিযোগ তুলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সংসদ সদস্যরা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও তোলেন কেউ কেউ। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার আমলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে স্বাগত জানায় বিএনপি। ষোড়শ সংশোধন বাতিলের ওই রায় ‘ভ্রমাত্মক’ বলে প্রতিক্রিয়া এসেছে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের সদস্য এ বি এম খায়রুল হকের কাছ থেকে। সুপ্রীমকোর্ট এই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশা প্রকাশ করেছেন, এতে তারা ‘কামিয়াব’ হবেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনী পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়। ওই প্রস্তাব পাসের আগে সংসদে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের এই রায় দিয়েছে। সংসদ ও গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই রায় দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
×