ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণের টানে নবান্নের ঢেউ শহরে, উদ্ভাসিত নগর

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

প্রাণের টানে নবান্নের ঢেউ শহরে, উদ্ভাসিত নগর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি...। সেই মধুর হাসিটি এখন কৃষকের মুখে। বাংলার মাঠ ভরে উঠেছে সোনালী ফসলে। পাকা ধানের শীষে দোল খাচ্ছে স্বপ্ন। যারপরনাই ব্যস্ত এখন কিষান কিষানী। ধান কাটা, মাড়াইয়ের কাজ চলছে। এরই মাঝে বুধবার চিরায়ত রীতি মেনে উদযাপন করা হলো নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণের প্রথম দিন গ্রাম ফসলের উৎসবে মেতেছিল গ্রামবাংলা। প্রাচীন উৎসবের সঙ্গে প্রাণের টানে যুক্ত হয়েছিল শহুরেরাও। রাজধানী ঢাকায় দিনভর চলে নবান্ন উৎসব। প্রাকৃতজনের জীবন ও লোক চেতনায় উদ্ভাসিত হয় নগর। অসাম্প্রদায়িক উৎসবে যোগ দিয়ে বাঙালীত্বের জয়গান করেন সকলেই। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবটি নবান্ন নামে পরিচিত। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। ইতিহাস বলে, হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা চালু হবার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। গ্রামীণ ঐতিহ্য মেনে এবারও খুব ভোর বেলায় সূচনা করা হয় নবান্ন উৎসবের। এদিন আকাশ ছিল মেঘলা। বৃষ্টি হয় হবে করছিল। এরই মাঝে চারুকলার বকুল তলায় সমবেত হতে থাকেন শেকড়ের সংস্কৃতির প্রতি অনুগত মানুষেরা। বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সকলেই গ্রামীণ ঐতিহ্যের পোশাক পরেছিলেন। নারীরা যে শাড়ি পরে এসেছিলেন, সেটি প্রতিদিন দেখা শহুরে রংয়ের ঢংয়ের নয়। গ্রামের নারীদের সহজ ভাব ভাষা যেন নিজেদের মধ্যে ধারণ করার একটি চেষ্টা। পুরুষেরা মূলত পাঞ্জাবী পরে এসেছিলেন। মাথায় কেউ গামছা বেঁধে নিয়েছিলেন। কেউ কৃষকের সেই বাঁশের তৈরি টুপিটা পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মিষ্টি মুখ, নূপুরের ছন্দ তুলে ছুটে বেড়ানো বেশ লাগছিল। মঞ্চটিও সাজানো হয়েছিল লোক ঐতিহ্যের উপাদান দিয়ে। কোলা মাটির হাঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে রঙিন মঞ্চ। সকাল সাতটা ১ মিনিটে সেখান থেকে ভেসে আসতে থাকে বাঁশির সুর। গাজী আব্দুল হাকিমের মতো বিখ্যাত শিল্পীর বাঁশিতে আড় মোড়া ভেঙ্গে জেগে ওঠে সবুজ চত্বর। বেশ কিছুক্ষণ লোক সুরে মাতিয়ে রাখেন তিনি। আর ফরিদা পারভীন তো মাটির মানুষটি। লালনে আকণ্ঠ ডুবে আছেন। সাঁইজী গানে নিজের আকুতির কথা জানিয়ে তিনি গান, ‘আমি একা রইলাম ঘাটে/ভানু সে বসিলো পাটে।/তোমা বিনে ঘোর সঙ্কটে/না দেখি উপায়...।’ স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী শাহীন সামাদ দেশমাতার বন্দনা করেন। নজরুল থেকে তিনি গান, ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী।/ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনী...।’ একই সময় একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন শামা রহমান ও সুমা রানী রায়। সম্মেলক গানেও তুলে ধরা হয় গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতি। দলীয় পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে ছিল উদীচী, বহ্নিশিখা ও সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা’ গানের সঙ্গে উৎসবের আমেজটা যেন ছড়িয়ে পড়ে। উৎসবের বড় অংশ জুড়ে ছিল নাচ। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে কাদামাটি, নৃত্যম, নটরাজ, নৃত্যজন, নন্দন কলাকেন্দ্র, আচিক প্রভৃতি সংগঠন। প্রায় প্রতিটি নাচেই গ্রামীণ আচার উৎস অনুষ্ঠান ও পার্বণের আনন্দঘন উপস্থাপনা। ধান কাটা, ঢেঁকিতে ধান ভানা, পিঠা পুলির আয়োজন ঘুরে ফিরেই আসে। ছিল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। কবিতার ভাষায়ও তুলে ধরা হয়েছে বাংলা ও বাঙালীকে। এদিন শিমুল মোস্তফার ভরাট কণ্ঠে ছিল সৈয়দ হকের সেই অমর কবিতা। বাঙালীর পরিচয় তুলে ধরে বাচিক শিল্পী বলছিলেনÑ আমি জন্মেছি বাংলায়/আমি বাংলায় কথা বলি।/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।/চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে...। নবান্ন কথন পর্বে অংশ নেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, ডাঃ এ এম শামীম প্রমুখ। আয়োজকদের মধ্যে এ সময় উপস্থিত ছিলেন লায়লা হাসান, শাহরিয়ার সালাম, মানজানর চৌধুরী ও বাবুল বিশ্বাস। পরে বের করা হয় নবান্ন শোভাযাত্রা। চারুকলা থেকে শুরু হয়ে টিএসসি চত্বর প্রদক্ষিণ করে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এ পর্যায়ে রং তুলি নিয়ে নবান্ন আঁকেন শিল্পীরা। নবান্ন বিষয়ক আর্ট ক্যাম্প চলে বেলা ৩টা পর্যন্ত। আর্ট ক্যাম্পে অংশ নেন সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবদুশ শাকুর শাহ, আবদুল মান্নান, রেজাউন নবী, কামাল পাশা চৌধুরী, মনিরুজ্জামান, জাহিদ মুস্তাফা, অশোক কর্মকার, এফ আর ভূটান, শামসুল আলম আজাদ, নাসিমা কুইনি, হিরণ¥য় চন্দ ও কিরিটি বিশ^াস। একই মঞ্চে উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় বিকেল ৩টায়। বাংলার ঢোলে স্বাগত জানানো হয় আগতদের। পরে লোক ঐতিহ্যের নানা আয়োজন নিয়ে মঞ্চে ছিলেন ঢাকার বাইরের শিল্পীরা। মানিকগঞ্জের চানমিয়া ও তার দলের লাঠিখেলা ঢাকার দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে। দারুণ উপভোগ্য ছিল নড়াইলের পটগান। নেত্রকোনা থেকে এসেছিলেন দিলু বয়াতি ও তার দল। তাদের ‘মহুয়ার পালা’ ছিল উৎসবের বড় আকর্ষণ। বিকেলের পর্বে সম্মেলক গান পরিবেশন করে ঋষিজ, উজান, মরমি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, পঞ্চায়েত, স্বপ্নবীণা। আবৃত্তি করে মুক্তধারা, ঢাকা স্বরকল্পন। তামান্না তিথি, রেজিনা ওয়ালী লীনা, ফয়জুল আলম পাপ্পু, আজিজুল বাশার কবিতায় নবান্ন উৎসবকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যাক্ষ, নান্দনিক, নৃত্যমঞ্চ, জাগো আর্ট সেন্টার ও বহ্নিশিখা। এদিন রবীন্দ্র সরোবর মুক্তমঞ্চেও আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসবের। বিভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে এই মঞ্চে ছিল বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, স্বভূমি লেখক শিল্পীকেন্দ্র, সুরসাগর, বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস ও ক্রান্তি। আবৃত্তি করেন শাহাদৎ হোসেন নীপু, রফিকুল ইসলাম, নিমাই ম-ল। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শেষ হয় নবান্ন উৎসব ১৪২৪-এর আয়োজন। এদিকে, নবান্ন উৎসবের দিনে বাংলার কৃষকের ঘরে হরেক পদের খাবার রান্না হয়েছে। তালিকায় ছিল সব ধরনের শাক। ভর্তা ভাজি। আর পিঠাপুলি পায়েসের কথা তো বলাই বাহুল্য। ঘরে ঘরে পিঠাপুলি পায়েস হয়েছে। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ করা হয়। হিন্দুদের মতে নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষরা অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন।
×