ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নবান্নে ১০ গাঁয়ের মানুষের উৎসব

বগুড়ায় ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রযুক্তি

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

বগুড়ায় ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রযুক্তি

সমুদ্র হক ॥ সকালে রবি মামার দেখা নেই। আকাশের মেঘ নেমে ঘন কুয়াশা। পথ চলতে দৃষ্টিসীমা কমে এসেছে। শিশির ঝরার সঙ্গে মৃদু বৃষ্টি। একটু করে শীতের কাঁপুনি। এরই মধ্যে দশ গাঁয়ের মানুষ স্রোতের মতো ছুটছে। কেউ গ্রামের সরু পথ ধরে। কেউ রাস্তা কমে নিচ্ছে জমির আইলের ওপর হেঁটে। হোঁচট খেয়ে পড়ছেও কেউ। তবু ঠোঁটের কোনায় মিষ্টি হাসি। কেউ পথ চলতেই লোকজ সুর তুলেছে। সকলের গন্তব্য বগুড়া সদরের নিভৃত গ্রামের এক স্কুল মাঠে। সেখানেই গাঁয়ের মানুষ মেতে ওঠে নবান্নের উৎসবে। আর এই উৎসবকে ঘিরে সদর উপজেলা পরিষদ ও শাখারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ আয়োজন করে নবান্নের ব্যতিক্রমী মেলা। কতই না আয়োজন ছিল এই মেলায়! সেদিনের গ্রামীণ জীবন থেকে আজকের প্রযুক্তির আধুনিকতা। কোন কিছুই বাদ যায়নি। মেলাকে সুন্দর করে সাজাতে সহযোগিতা দিয়েছেন সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগের বগুড়ার উপপরিচালক সুফিয়া নাজিম। দর্শনার্থীরা মেলায় প্রবেশ করতেই গ্রামের নারী বাদ্যের তালে লোকজ সুর তুলে তাদের বরণ করে নিচ্ছে। বগুড়া নগরী থেকে উত্তর দিকে পাকা সড়ক ধরে তিন কিলোমিটার। তারপর গ্রামের পথ ধরে প্রায় ১২ কিলোমিটার গেলেই দৃষ্টিতে আসবে পল্লীমঙ্গল বারুইপাড়া গ্রাম। এই বরুইপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গাছ গাছালির মধ্যে আয়োজন করা হয় নবান্নের মেলা। মেলার স্লোগান ছিল ‘মেতে উঠি নবান্নের উৎসবে’। নিভৃত এই গ্রামেও নবান্নের সূচনা হয় র‌্যালি করে। তারপরই অনুষ্ঠান মঞ্চে ধান কাটার প্রতীকী অনুষ্ঠান করে গ্রামের কৃষক। মাঠের চার ধারে বসানো হয় স্টল। বেশিরভাগ স্টল ছিল পিঠার। স্টলের নামগুলো সুন্দর। শাপলা শালিক, পিঠার রঙের খেলা, পিঠার মেলা, নবান্নের পিঠা, ঝিঙে পিঠার মেলা, পিঠার খেলাঘর, মিষ্টি ছেলের দলের পিঠার সুর। মেলাকে ঘিরে গ্রামে আত্মীয় স্বজন মেয়ে জামাইকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। তারাও নবান্নের উৎসবে অংশ নেয়। গ্রামীণ জীবনের নবান্নের এসব স্টলের মধ্যেই ঠাঁই পেয়েছে প্রযুক্তির আধুনিকতা। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, শশী বদনী আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প, পল্লী মঙ্গল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ২০টি স্টল। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তির (আইসিটি) সার্বিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। তথ্য সেবাও পাওয়া গেল এ সেন্টারে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ফসলের বর্ণনা দেয়। শশী বদনী গ্রামের নামটি যেমন সুন্দর তেমনই সুন্দর তাদের আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প। শশী অর্থ চাঁদ। বদনী অর্থ মুখ। এই চাঁদ মুখের আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলছে। রঙের খেলা পিঠা স্টলের রোজী ও পান্না বললেন, নবান্নের মেলার জন্য রাত জেগে তারা পিঠা বানিয়েছেন। শাখারিয়া গ্রামের কৃষক মনসুর আলী বললেন ‘নিত্তি বছর হামরা গাঁওত নবান করি। ধান কাটার সময় গান কয়া কয়া কাটি। গাঁয়ের বৌ গীত কয়া লাচে। পৌষ মাসত হামরা জমির মধ্যে যায়া পুসনা করি। এই নবানের জন্যি হামরা অয়া থাকি...(প্রতি বছর আমরা গ্রামে নবান্ন করি। ধান কাটার সময় গান গাই। গাঁয়ের বধূরা নেচে নেচে গীত গায়। পৌষ মাসে জমির মধ্যে গিয়ে চড়–ইভাতি করি। এই নবান্নের জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকি’)। গ্রামের মানুষের এই অপেক্ষা এবারের নিভৃত গ্রামের নবান্নের মেলা সার্থক করে তুলেছে। এমন আয়োজন এবার বগুড়া নগরীতে হয়নি। রাজশাহীতে নানা আয়োজন মামুন-অর-রশিদ রাজশাহী থেকে জানান, হালকা কুয়াশা আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই শুরু হলো এবারের অগ্রহায়ণের প্রথম দিন। দিনটি এলো কৃষকের আনন্দধারা হয়ে। মাঠের সোনালি পাকা ধানের ঢেউ যেন উঠে এলো কৃষকের উঠানে। কৃষকের এ আনন্দধারার উপলক্ষ-বাড়ির উঠোনে নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ। কালটা হেমন্ত। অগ্রহায়ণ তার দ্বিতীয় মাস। কৃষকের মনে তাই নতুন ধানের স্বপ্ন। কবির ভাষায়-হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায়-জাগবে ফসলের বান...। ঠিক এ বাক্যের পরিপূর্ণতা পেয়েছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠে মাঠে। একযোগে শুরু হয়েছে ধান কাটার উৎসব। হিম হিম হেমন্ত দিনে, প্রাণ নবান্ন শুরু হলো সবখানে। ব্যতিক্রম হয়নি রাজশাহী অঞ্চলে। জেলার গোদাগাড়ী, চারঘাট, তানোরসহ বিভিন্ন উপজেলায় অগ্রহায়ণের শুরুর দিন থেকে শুরু হয়েছে নবান্ন উৎসব। একযোগে ধান কাটার মধুক্ষণ। বুধবার রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় নবান্ন উৎসব শুরু হয়েছে একযোগে। সকালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা কৃষি অধিদফতর দিনটিকে আনন্দ উৎসবে পালন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জাহিদ নেওয়াজের সভাপতিত্বে উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও স্থানীয় সুধীজনদের নিয়ে সকালে উপজেলা ক্যাম্পাসে ভাপা পিঠা খাওয়ার আয়োজন করে। সেখানে বাংলার নবান্ন উৎসবের আয়োজন নিয়ে এক অন্তরঙ্গ আলোচনা শুরু হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন গোদাগাড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ ইসহাক আলী। এখানে এসেছিলেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান, রওশন আরা, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মরিয়ম আহম্মেদ, উপ-সহকারি উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোঃ শফিকুল আলম, কৃষি কর্মকর্তা আবুল হোসেন ছাড়াও স্থানীয় কৃষকরা। পরে গোদাগাড়ী লালবাগ হেলিপ্যাড মাঠে বাংলার কৃষক বেশে ধান ধান কাটার কাস্তে, মাথায় মাথইল, ঘাড়ে লাল গামছা বেঁধে ধানের জমিতে ধান কাটা ও মাড়াই করা হয়। এই সময় এক আনন্দ ঘন মুহূর্ত সৃষ্টি হলে হাসি আর মাজার আমেজ উঠে আসে। শুধু গোদাগাড়ীতে নয়, জেরার অন্য উপজেলাতেও নবান্ন উৎসব শুরু হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। এর মধ্যে জেলার চারঘাটে নবান্ন উৎসবকে ঘিরে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ধান কাটা, র‌্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিতে নবান্ন উৎসব স্টাফ রিপোর্টার গাজীপুর থেকে জানান, নবান্ন উৎসব বুধবার উদযাপন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। গাজীপুরে প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তরে ব্রি কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। দিনব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে ছিল নবান্ন শোভাযাত্রা প্রদক্ষিণ, পায়েস এবং হরেক রকমের হাতে তৈরি পিঠা বিতরণ। উৎসবের এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’। কর্মসূচীতে ব্রির মহাপরিচালক, পরিচালক (প্রশাসন), পরিচালকসহ (গবেষণা) ব্রির সর্বস্তরের বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা, কর্মচারী, শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন।
×