ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার সালাম

দুই দশকের দ্বারপ্রান্তে নবান্ন উৎসব

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

দুই দশকের দ্বারপ্রান্তে নবান্ন উৎসব

প্রতিবছরই হেমন্ত আসে নবান্নের শুভবার্তা নিয়ে। নবান্ন শব্দের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আনন্দ, হাসি এবং উৎসব, আছে সংস্কৃতির চেতনা, ঐতিহ্যের সুঘ্রাণ ও সভ্যতার অহঙ্কার। নারীদের হাতে কৃষি সভ্যতার শুরু সম্ভবত ৩০-৫০ হাজার বছর আগে। তখন থেকেই ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের শুরু। মানুষের চিরন্তন, সবচেয়ে প্রাচীন এই ফসলের উৎসব যা বাংলাদেশে বা বাঙালীর কাছে ‘নবান্ন উৎসব’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় সকল আদিবাসী বা সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব ‘নবান্ন’। এমনকি বর্তমানে আধুনিক যুগেও পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই অন্যতম প্রধান উৎসব নবান্ন বা ফসলের উৎসব, স্থান-কাল-ভাষাভেদে নাম বা উদযাপনের ধরনে ভিন্নতা আছে। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীতে মানুষ যত ধরনের উৎসব উদযাপন করে এগুলোর শেকড় বা উৎপত্তি বেশিরভাগই ফসলের উৎসব থেকে। নবান্ন উৎসব বা ফসলের উৎসব থেকেই বিভিন্ন দেশে বা জাতিতে বিভিন্ন উৎসবের উদ্ভব হয়েছে। অসংখ্য দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারী ছুটি দিয়ে ফসলের উৎসব উদযাপন করা হয়। একদা বাংলার প্রধান উৎসব ছিল নবান্ন। খুবই দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে তো দূরের কথা সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব আয়োজন কষ্টসাধ্য। রাষ্ট্র কিংবা সরকার নবান্ন উৎসবকে তেমন কোন গুরুত্ববহ হিসেবে বিবেচনা করে বলে মনে হয় না। এমনকি অনেকেই এটিকে আর ক’টি ঋতুভিত্তিক উৎসবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। ফসল উৎপাদন ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হলেও এটি যেমন হেমন্তের তেমনি এটির শেকড় প্রাচীন সভ্যতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, খাদ্য, বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং অর্থনীতি ও উন্নয়ন-সবদিকে নবান্ন। আমরা গত প্রায় দুই দশক ধরে সরকারের কাছে আপনাদের মাধ্যমে বারবার দাবি জানিয়েছি পহেলা অগ্রহায়ণকে ‘জাতীয় নবান্ন উৎসব দিবস’ ঘোষণা করে সরকারী ছুটি প্রদানের জন্য। কয়েক বছর আগে পহেলা অগ্রহায়ণকে কৃষি দিবস ঘোষণা করলেও এখনও তা সরকারীভাবে পালিত হচ্ছে না। তবে আমরা আশাবাদী বর্তমান সংস্কৃতিবান্ধব সরকারের ভূমিকায়ই সম্ভব নবান্ন উৎসবের রাষ্ট্রীয় আয়োজন বা সরকারী ছুটি ঘোষণা। কেননা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তিনি তখনকার নবান্ন উৎসব আয়োজনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে সরকারী অনুদানও অনুমোদন করেছিলেন, যদিও সেই উদ্যোগটি আলোর মুখ দেখেনি। এবারের উৎসবের বেশকিছু বিশেষত্ব রয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ঢাকার বাইরে নড়াইল থেকে নিখিল চন্দ্র ও তার দলের পটগান, নেত্রকোনার কেন্দ্রয়া থেকে দিলু বয়াতী ও তার দলের মহুয়ার পালা, মানিকগঞ্জের চানমিয়া ও তার দলের লাঠিখেলা, খুলনা থেকে ধামাইল গানের দল উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। ঢাকার বাইরের দলগুলো ছাড়াও ঢাকার প্রায় ৪৭টি সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি সংগঠন অংশ নেবে সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তিতে, অন্তত ৬০ জন একক শিল্পী সঙ্গীত ও আবৃত্তি পরিবেশন। আর্ট ক্যাম্পে প্রবীণ শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবদুল মান্নান, আবদুশ শাকুর শাহসহ ২০ জন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অংশ নিচ্ছেন। একদিনের উৎসবে এতে বিপুলসংখ্যক শিল্পী ও সংগঠন অংশ নেয়া বাংলাদেশে বিরল। এ বছর দেশের উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছে জাতীয় পর্ষদ। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রকৃতির ভিন্ন আচরণ প্রায়ই আমাদের ফসলের, জানমালের ক্ষতি করে যায়। তারপরও অভাব-অনটন, মঙ্গা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা পিছনে ফেলে এই অগ্রহায়ণে কৃষক আবার ঘুরে দাঁড়ায়, আবার স্বপ্ন দেখে, নবান্নের উৎসবে মেতে ওঠে। হয়ত কখনও কখনও সেই উৎসব পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেশের মানুষ যেমন হাতে হাত রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যেমনি ভিন দেশের উদ্বাস্তুদের বুকে আগে ধরে সাধ্যমতো আতিথেয়তায় সচেষ্ট হই, তেমনি উৎসবপ্রিয় বাঙালী কোন পরাভব না মেনে উৎসবে এগিয়ে চলে। বাঙালী চিরকাল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে আবার ঘুরে দাঁড়ায়। জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতির প্রধান বিষয় নিজস্ব উৎসব। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বাঙালী এবং বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব উৎসবগুলোই আমাদের এখনও একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিদ্বেষহীনভাবে বাঁচতে শেখায়। এগুলো শুধু অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সুদৃঢ় করে তা-ই নয়; সমাজে-রাষ্ট্রে মানবিকতাবোধ, সৌভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করে রাষ্ট্রকে সঠিক দিকে পরিচালনায় সহযোগিতা করে। নবান্ন উৎসব শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি আমাদের চেতনা, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, সম্প্রীতি, মা-মাটি-মানুষের শেকড়ের উৎসব। এর সঙ্গে কৃষি-কৃষক-অর্থনীতি, উন্নয়ন, খাদ্য, সচ্ছলতা সবই নিগূঢ়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আমরাও সেই শেকড় সন্ধানে ব্রতী হয়েছি। আমরা যদি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নবান্ন নাটক কিংবা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের নবান্ন শীর্ষক বিশাল স্ক্রলের কথাও মনে করি, সেগুলোও যেমন শিল্পোত্তীর্ণ কালজয়ী সৃষ্টি, তেমনি ভেতরে রয়েছে গভীর চেতনাবোধ। অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-মুক্তবিবেক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ ও দেশ গড়তে নবান্ন উৎসবের ব্যাপক আয়োজন ও এর প্রসার খুবই জরুরী। যে কোন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক উৎসবের ভূমিকা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বিশ্বজুড়ে যখন হিংসা, হানাহানি, ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র যখন অসীম আকার ধারণ করছে নবান্ন উৎসব তখন শান্তি ও সৌ-ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানায়। সকল সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদমুক্ত একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা চাই। সরকার এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষের উচিত নবান্ন উৎসবসহ সকল অসাম্প্রদায়িক উৎসবগুলোকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সচেষ্টা হওয়া। এই উৎসবগুলো যত বেশি আয়োজন হবে, এর পৃষ্ঠপোষকতা যত বৃদ্ধি পাবে, এর দর্শক-শ্রোতা যত সমাবেশ ঘটবে, এর ব্যাপ্তি যত বৃদ্ধি পাবে ততটাই জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতা মুক্তি একটি সোনার বাংলার স্বপ্ন সফল হবে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশীয় ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির দিকে নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করা। দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় প্রয়োজন সকলের অংশগ্রহণ, আন্তরিকতা এবং আর্থিক সহযোগিতা। পরবর্তী প্রজন্মও নিজের মাটির এবং শেকড় আঁকড়ে ধরতে পারে সেজন্য সকলে সচেষ্ট হই। ভিনদেশী সংস্কৃতি থেকে ভালটুকু গ্রহণ করে মন্দকে বর্জন করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠা খুব জরুরী। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জন্য সুস্থ সুন্দর পরিবেশ। আমরা জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদ এদেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই সকল হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানি ভুলে দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করি, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিজেদের বিবেক জাগ্রত রাখি, আগামী প্রজন্মের জন্য সত্যিকারের ধনধান্যে পুষ্পেভরা একটি সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা উপহার দিতে কাজ করি। লেখক : আহ্বায়ক, জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদ
×