ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশ অস্থিতিশীল করতে ফের নাশকতা - সর্বশেষ ঘটনা রংপুরে ঠাকুরপাড়ায়

জামায়াত-শিবিরের ৫০ হাজার আসামি এখন প্রকাশ্যে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৪ নভেম্বর ২০১৭

জামায়াত-শিবিরের ৫০ হাজার আসামি এখন প্রকাশ্যে

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে হওয়া ১ হাজার ১শ’ মামলার তদন্ত থেমে গেছে। গত দুই বছর ধরে এসব মামলার তদন্ত থেমে থাকায় প্রায় ৫০ হাজার আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব আসামির বিরুদ্ধে খুন, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, অস্ত্র লুট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা, সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের প্রাধান্য আছে এমন ২২ জেলায় আবারও সংগঠিত হচ্ছে তারা। এই ধরনের গুরুতর অভিযোগের আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মী-ক্যাডারদের অনেকেই জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর ঘটনায় অংশ নিচ্ছে। রংপুরের হিন্দু পাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো এ সবেরই বহির্প্রকাশ বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুই বছরে এসব নাশকতার মামলায় পুলিশ-বিজিবি সদস্যদের খুন, পুলিশের ফাঁড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, অস্ত্র লুট, সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর অভিযোগ ৩ হাজার ৫শ’ মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলার আসামির সংখ্যা লক্ষাধিক। এর মধ্যে বেশিরভাগ আসামিই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সারাদেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে ১ হাজার ১শ’ মামলার তদন্তই এখনও পর্যন্ত শেষ হয়নি। আর এ কারণেই জামায়াত-শিবির মাঝে মধ্যেই সংগঠিত হয়ে সহিংস তা-বলীলা চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘটে যাওয়া নাশকতার সাড়ে তিন হাজার মামলার মধ্যে ১ হাজার ১শ’ মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বেশিরভাগ মামলার আসামিদের নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি কিংবা আসামিদের নাম ঠিকানা একই হওয়ায় এক জটিল ও ধূম্রজাল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি আসামিদের সঙ্গে গোপন সম্পর্কের অভিযোগ রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সদরদফতর থেকে চলতি বছরের মধ্যেই এসব মামলার তদন্ত শেষ করার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আলোচ্য সময়ে রেলে নাশকতার ১৫৬ মামলার মধ্যে ১৩৫টি মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয়া সম্ভব হয়েছে আদালতে। মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ায় ১৭টি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। বাকি মামলার তদন্ত এখন সিআইডির হাতে। কৌশলগত কারণে এসব মামলার তদন্ত দেরি হচ্ছে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে দ্রুতই এসব মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র পাঠানো হবে এবং পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে জামায়াত শিবিরের সদস্যরা। তারা বগুড়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নীলফামারী, গাইবান্ধা, রংপুরসহ ২২টি জেলায় ব্যাপক নাশকতা চলায়। থানা ও ফাঁড়ি আক্রমণ করে পুলিশ সদস্যদের খুন করতেও পিছপা হয়নি। এরপর ২০১৪ ও ২০১৫ সালেও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের রায়কে কেন্দ্র করে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। জামায়াত-শিবির মোকাবেলায় পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে পিছুহটে তারা। এমন পরিস্থিতিতে ওই সময়ে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা ও থানায় অন্তত ৩ হাজার ৫শ’ মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে, ২০১৩ সালের নাশকতার ১৫শ’ ৪০টি, ২০১৪ সালের ১১৭১টি এবং ২০১৫ সালে ১ হাজার ছয়শটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলার আসামিরা সবাই জামায়াত শিবিরের সদস্য। এসব মামলার মধ্যে অনেক মামলা এখনও তদন্তাধীন। এছাড়া আদালতে ২৪শ’ মামলার অভিযোগপত্র পাঠানো হয়েছে। বাকি ১১শ’ মামলার আসামিদের নাম ঠিকানা আগের মামলার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন তদন্ত কর্মকর্তারা। এ কারণে এসব মামলার ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে এবং বাদ বাকিগুলো মামলার ক্ষেত্রেও একই সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরে এখনও ১শ’ ২৬টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরে ১শ’ ৭টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১১ জেলায় ৩শ’ ৫৬টি, রাজশাহী রেঞ্জে ২শ’ ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২শ’ ৩টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭৪টি, সিলেট রেঞ্জে ৬৩টি, রংপুর রেঞ্জে ৬৯টি, খুলনা রেঞ্জে ৭৬টি, রেলওয়ে থানায় ৪টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশ আসামিই হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের কেন্দ্রীয় থেকে স্থানীয় নেতাকর্মী। মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে রেলে নাশকতার ঘটনায় দায়েরকৃত ১২৪টি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেছে রেলওয়ে পুলিশ। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৭শ’ ৪১ জনকে। এর মধ্যে ঘটনার কোন সাক্ষী বা তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় দেয়া হয়েছে ১৭টি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট। এ ছাড়া নাশকতার ঘটনায় দায়েরকৃত কয়েকটি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। নাশকতা চলাকালে বিভিন্ন অভিযানে এজাহারভুক্ত ১শ’ ৫৩ জনসহ মোট ৮শ’ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামির অধিকাংশই এখন জামিন নিয়ে পলাতক। তারা সবাই জামায়াত শিবিরের সদস্য বলে তদন্ত তদারক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে রেলে নাশকতার ঘটনায় মোট ১৫৬টি মামলা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজার আদেশ ঘোষণার পর রেলকে টার্গেট করে ব্যাপক নাশকতা চালায় জামায়াত-শিবির। এরপর ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন সরকারবিরোধী কর্মসূচী বাস্তবায়নের নামে দেশজুড়ে রেলকে টার্গেট করে নাশকতা চালায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। রেলকে টার্গেট করে চালানো এসব নাশকতার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় ছয় সহস্রাধিক অজ্ঞাত দুর্বৃত্তকে আসামি করে মামলা করা হয়। নাশকতায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় ৬৭৫ জনকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৯ জন নাশকতায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। ঘটনার চারবছর পার হয়ে গেলেও জড়িতদের খুঁজে বের করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, আসামি গ্রেফতার না করে এবং এজাহারভুক্ত কিছু আসামি বাদ দিয়েই নাশকতার মামলাগুলোতে অভিযোগপত্র ও ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। এ ছাড়া রয়েছে দায়সারা তদন্তেরও অভিযোগ। যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের কারণে ভবিষ্যতে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন আইনজীবী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ২০১৩ সালের পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া নাশকতার ঘটনায় লাকসাম রেলওয়ে থানায় ১৮টি মামলায় ১৭৮ জনকে এজাহারভুক্ত ও দুই হাজার ৪৩৫ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় উল্লেখ করে আসামি করা হয়। এর মধ্যে পুলিশ এজাহারভুক্ত ৩৩ এবং সন্দেহভাজন ১২৮ জনকে গ্রেফতার করে। সব মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। এর বাইরে চাঁদপুরে ১৩, আখাউড়ায় ৮, ভৈরবে ৬, ঢাকায় ৭, কিশোরগঞ্জে ২, ময়মনসিংহে ৫, জামালপুরে ৫, শ্রীমঙ্গলে ২, কুলাউড়ায় ২ এবং সিলেট রেলওয়ে থানায় ৬টি নাশকতার মামলা করা হয়েছিল। এ ১০টি থানায় ৫৬টি মামলায় ৩১৩ এজাহারভুক্ত এবং অজ্ঞাতপরিচয় তিন হাজার ৪২৯ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৩১ এবং সন্দেহভাজন ২৬৩ আসামি পুলিশ গ্রেফতার করে। এসব মামলায় পুলিশ ৪২টিতে অভিযোগপত্র এবং ৭টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, জামায়াত-শিবিরে কর্মী-ক্যাডারদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগে মামলা দায়ের করা সত্ত্বেও আসমিরা ধরা পড়ছে না কিংবা যারা ধরা পড়েছে তাদের বেশিরভাগই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার সহিংস সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে। আর এ কারণেই জামায়াত-শিবিরের কর্মী-ক্যাডারা রংপুরে হিন্দু বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাতে সাহস দেখিয়েছে। জামাাত-শিবিরের যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে এবং মামলার যারা আসামি তাদের বিরুদ্ধে আবারও গ্রেফতার অভিযান চালানো হবে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
×