ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় না মন্ত্রণালয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৪ নভেম্বর ২০১৭

বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় না মন্ত্রণালয়

রশিদ মামুন ॥ এখনই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে চায় না মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির নিম্নমুখী দরে যেখানে উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব, সেখানে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচের মধ্যে অতিরিক্ত যে ব্যয় ধরা হয়েছে সেগুলো সমন্বয় করে দাম স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে এর মধ্যে আলোচনাও হয়েছে। যদিও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ওপরই বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছে সরকার। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বিষয়ে রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মন্ত্রণালয় এবং বিইআরসির বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসংক্রান্ত একটি বৈঠক হয়েছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সভাপতিত্বে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আরও একটি বৈঠক হয়। দুটি বৈঠকের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে কিছু জানানো হয়নি। সোমবার এ বিষয়ে বিইআরসিতে খোঁজ নিলেও বৈঠকের বিষয়ে কেউ কিছু বলতে সম্মত হননি। যদিও বিইআরসি আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে। সেক্ষেত্রে হিসাব করে দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে বাড়বে আর বৃদ্ধির দরকার না হলে বাড়বে না বলে জানা গেছে। বিইআরসির বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে আলাপ করে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে এমন মনোভাব জানা গেছে। তবে কেউ এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলতে চাইছেন না। চলতি মাসেই এ সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিইআরসি। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি বিদ্যুত জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ বিষয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি বিইআরসিতে রয়েছে। বিইআরসি সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন, সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করছে না। বিশ্ববজারে নিম্নমুখী জ্বালানির দরের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদর খরচ যেখানে কমানো সম্ভব, সেখানে কেন বৃদ্ধি- তা নিয়ে আগে থেকে প্রশ্ন ছিল। সরকার জ্বালানি তেল বিক্রিতে অতিরিক্ত মুনাফা করার জন্যই বিদ্যুত উৎপাদনেও তেলের দাম সমন্বয় করছে না। বেসরকারী বিদ্যুত উৎপাদনকারীদের অনেকে ফার্নেস তেল আমদানি করলেও সরকারী ফার্নেস তেল এবং ডিজেলের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশ। তবে দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারকে আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে। গত কয়েক মাসে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিরতা হারিয়েছে। চালের দর বৃদ্ধি নিয়ে বিপাকে রয়েছে সাধারণ মানুষ। এছাড়াও তেল, পেঁয়াজ, চিনিসহ প্রায় সব পণ্যের বাজার উর্ধমুখী। এখন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হলে সঙ্গে সঙ্গেই আরও এক দফা মূল্যস্ফীতি ঘটবে, যা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। একই সঙ্গে এখনও গ্রামে বিদ্যুতের সরবরাহ অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। এখনই দর বৃদ্ধি সমালোচনাকেও উস্কে দেবে। জানতে চাইলে বিইআরসি চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এখনই দাম বাড়ছে কি-না তা বলার সময় আসেনি। আমরা হিসাব করে দেখছি কী দাঁড়ায়। চলতি মাসের মধ্যেই এ সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়া হবে। তবে ‘কস্ট অব ইলেক্ট্রিসিটি এবং কস্ট অব নো ইলেক্ট্রিসিটি’র বিষয়টিও সবাইকে চিন্তা করতে হবে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে সম্মত হননি। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দাবি করছে, বর্তমানে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয় ৫ দশমিক ৫৯ টাকা। অথচ পিডিবি পাইকারি প্রতি ইউনিট বিদ্যুত ৪ দশমিক ৮৭ টাকায় সররাহ করছে। এতে দেশের একক পাইকারি বিদ্যুত ক্রয়-বিক্রয় প্রতিষ্ঠান পিডিবির ইউনিটপ্রতি আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৭২ পয়সা। পিডিবি এ ৭২ পয়সা সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছে বিইআরসিতে। বিইআরসির কারিগরি কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে বলা হচ্ছে, বিদ্যুতের পাইকারি দর সর্বোচ্চ ইউনিটপ্রতি প্রতি ৫৭ পয়সা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১ দশমিক ৭৮ ভাগ বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে। কিন্তু দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এবারই মন্ত্রণালয় এবং বিইআরসি ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ক্যাব) প্রধান্য দিয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে এবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরিবর্তে কিভাবে দাম কমানো যায়, সে বিষয়ে শুনানি হয়। এর পর মন্ত্রণালয়ও এসব যুক্তি শুনতে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। এখানে ক্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে অন্তত ৬৬ পয়সা অতিরিক্ত দেখানো হয়েছে। আর কমিশন তাদের সুপারিশে ৫৭ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এতে এ দাম ৯ পয়সা কমানো যায়। ক্যাব তাদের যুক্তি তুলে ধরে বলছে, কৃষি সেচ ও প্রান্তিক গ্রাহকদের কম দামে বিদ্যুত দেয়ায় ৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। সরকার বলে আসছে এ লোকসান ভর্তুকি হিসাবে দেয়া হচ্ছে। অথচ সরকার বিদ্যুত খাতে ভর্তুকি না দিয়ে ঋণ দিচ্ছে, ওই ঋণের ওপর আবার সুদও নিচ্ছে। এতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি সাড়ে ২৬ পয়সা ঘাটতি থাকছে। বিদ্যুত খাতের ঋণকে ভর্তুকিতে রূপান্তর করলে ইউনিটপ্রতি দাম দাম ২৬ পয়সা কমে। এছাড়া ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার ঘাটতি ৫ পয়সা, মেঘনাঘাট আইপিপিতে ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ডিজেল ব্যবহারে আরও অতিরিক্ত ১৪ পয়সা ব্যয় বেড়েছে। এর সবগুলো সমন্বয় করা সম্ভব হলে আর দাম বাড়াতে হয় না। ক্যাবের এসব যুক্তি পিডিবির পক্ষ থেকেও একেবারে অগ্রাহ্য করা হয়নি।
×