ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যানবাহন কম হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ;###;২০২০ সালের মধ্যে দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্যোগ

ওভারলোডিং ওভারটেকিং যান্ত্রিক ত্রুটি ॥ দুর্ঘটনার তিন কারণ

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৪ নভেম্বর ২০১৭

ওভারলোডিং ওভারটেকিং যান্ত্রিক ত্রুটি ॥ দুর্ঘটনার তিন কারণ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিশ্বের মধ্যে ১৩ তম। বাংলাদেশের উপরে আছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। কিন্তু দেশগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ১ হাজার ১৩৩ যানবাহন রয়েছে, চীনে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৮ হাজার, ভারতে প্রায় ১৩ হাজার আর পাকিস্তানে পাঁচ হাজার। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি দুজনে একটি করে যানবাহন রয়েছে। অথচ এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বেশি। এই প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক এ্যাকশন প্ল্যান’। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপত্তার স্বার্থে দেশের জাতীয় ২২ মহাসড়কে তিন চাকার স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে রবিবারের সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক থেকে। মূলত নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে মহাসড়কে এখন অটোরিক্সা, নসিমন, করিমন, ভটভটি, ভ্যান, ব্যাটারিচালিত রিক্সাসহ সব ধরনের ১০ লাখের বেশি নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলে এখন আর কোন বাঁধা রইল না। এতে সড়ক দুর্ঘটনা গত দুই বছরে ৩৩ভাগ কমলেও তা আবারও বেড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া তিনমাস অন্তর আন্তঃসড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক হবার কথা থাকলেও তা একেবারেই অনিয়মিত। সড়ক নিরাপত্তার স্বার্থে গেল আট বছরে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল এর অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। কিছু বাস্তবায়ন হলেও একেবারেই নামেমাত্র বলা চলে। ১০ মাস পর গত রবিবার নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি বৈঠক হয়েছিল। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মহাসড়কে ২৬০টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক আজও সরলীকরণ হয়নি। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়নি। ৩২লাখ রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত গাড়ির বিপরীতে অবৈধ চালকের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। সড়ক-মহাসড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান রাজনৈতিক কারণে করা সম্ভব হয় না। বিচার হয় না দুর্ঘটনার জন্য দোষী চালকের। এই প্রেক্ষাপটে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে সত্যিই কঠিন তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত তিন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। ওভারস্পীড, ওভারটেকিং, যান্ত্রিক ও রাস্তার ত্রুটি। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস না পাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। চালকের লাইসেন্স প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে যানবাহনের ফিটনেস সনদ, গাড়ির অনুমোদন, সড়কের ত্রুটি, সঠিক তদারকির অভাবসহ সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে গলদ। রবিবার সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী পুলিশসহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উদ্দেশে বলেছেন, সামনে নির্বাচন; তাই নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়া যাবে না। কোন অবস্থাতেই সরকার বা দলের ক্ষতি করবেন না। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের ভোট দেবে না। তাই নির্বাচনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশকে একদম কঠোর হলে চলবে না। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানামুখী পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবায়ন গতি খুবই কম। এ নিয়ে প্রতি বৈঠকে হইচই হয়। কিন্তু কাজ হয় না। এটি এখন আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করলে কখনই সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে না। ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি ॥ এদিকে সুুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে দাবি করেছে যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনের মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, উন্নত দেশগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা খুবই সুনির্দিষ্ট হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দায়সারা গোছের। কত বছরে কি পরিমাণ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানো হবে। কীভাবে তা অর্জিত হবে, কারা তা সফল করবে। এটা স্পষ্ট করা জরুরী। পরিকল্পনা করে রেখে দিলে বা প্রতিদিন নতুন নতুন কথার ফুলঝুরি দিলে দুর্ঘটনা কমবে; এটা আশা করা ঠিক নয় বলেও মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির প্রায় ৪৭ শতাংশ পথচারী দাবি করে সংগঠনের দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, স্বল্প ব্যয়ে ফুটপাথ, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। গতি নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে ছোট যানবাহন বন্ধ ও বেপরোয়া যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরী। এছাড়া এখনও দেশের সড়ক-মহাসড়কে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে ১০ লাখ নছিমন-করিমন-ইজিবাইক। অবাধে আমদানি হচ্ছে অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, ইজিবাইক। দেশব্যাপী ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, কভার্ডভ্যান, হিউম্যান হলার অবাধে চলছে। নিবন্ধনবিহীন ৪ লাখ অটোরিক্সা ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে সড়ক-মহাসড়কে। এসব যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান উৎস। তিনি বলেন, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা সড়ক দুর্ঘটনা না কমার একটি বড় কারণ। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা। চালক-মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব এই সেক্টরকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে। সরকার সড়ক নিরাপত্তায় জনবান্ধব যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে তারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সড়ক নিরাপত্তা আজ মারাত্মক হুমকির মুখে বলে দাবি করেন তিনি। ২০ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামাতে চায় সরকার ॥ আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে অনুমোদিত হয়েছে ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক এ্যাকশন প্ল্যান। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৫তম সভায় একশন প্ল্যান অনুমোদন হয়। সভায় জানানো হয়, গৃহিত পরিকল্পনায় সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে প্রতি দুমাস পরপর সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া সভায় সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে এক্সেললোড কন্ট্রোল নীতিমালা আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শীতের সময় দুর্ঘটনা এড়াতে ক্ষেত্রবিশেষে যানবাহনের গতি সীমিত রাখার বিষয়েও সভায় সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এ্যাকশন প্ল্যানের ভূমিকায় বলা হয়, প্রতিবছর দেশে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। পুলিশের পাঁচ বছরের হিসাব অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার ২৮০ জনের মৃত্যু হয়। সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো ওভারস্পীড, ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং। আবার একই সড়কে ছোট-বড়, ধীরগতি ও অতি গতি এবং অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচলের কারণেও সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অসচেতনতা ও প্রয়োগের দুর্বলতাও দুর্ঘটনার কারণ। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব চিহ্নিত সমস্যা সমাধানের জন্যই মূলত এ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে। এ্যাকশন প্ল্যানে সড়কের ত্রুটি সংশোধন এবং ডিজাইন তৈরির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত সড়ক নির্মাণের কথা বলা হয়। এছাড়া সড়কে দুর্ঘটনার প্রকৃত তথ্য নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রকাশ করে। এ্যাকশন প্ল্যানে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণের জন্য পুলিশ, বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, এলজিইডি, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, বুয়েটে এক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট (এআরআই) কাজ করবে। এ ছাড়া ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে সরকারী বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)সহ বেসরকারি সংগঠনকে দায়িত্ব দেয়া হবে। ১০ মাসে দুর্ঘটনায় নিহত সাড়ে ৩ হাজারের বেশি ॥ সারাদেশে গত ১০ মাসে ২ হাজার ৯২৬ সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬০৮ নিহত ও ৭ হাজার ৭৮৬ জন আহত হয়েছেন। নিহতের তালিকায় ৪২৩ নারী ও ৪৬৫ শিশু রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে এসব দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। বেসরকারী সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) নিয়মিত মাসিক জরিপ ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সংগঠনের তথ্য মতে, গত ১০ মাসের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে সর্বাধিক ৩৭২ দুর্ঘটনায় ৫৬ নারী ও ৫৮ শিশুসহ মোট ৪৭২ নিহত ও ১ হাজার ৯৪ জন আহত হয়েছেন। কম দুর্ঘটনা ঘটেছে আগস্টে। এ মাসে ২১৭ দুর্ঘটনায় ২৫ নারী ও ৩১ শিশুসহ মোট ২৭৯ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং আহত হন ৫০৩ জন। কমিটির তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটলেও জুন মাস থেকে তা কমতে শুরু করে। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আবারও বেড়ে যায়। জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, তাদের পর্যবেক্ষণে বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৯টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, সড়ক-মহাসড়কে মোটর সাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি, স্থানীয়ভাবে তৈরি দেশীয় ইঞ্জিনচালিত ক্ষুদ্রযানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, বিধি লঙ্ঘন করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং, জনবহুল এলাকাসহ দূরপাল্লার সড়কে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, দীর্ঘক্ষণ বিরামহীন গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও বেহাল সড়ক, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ।
×