ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভিশন ২০২১ সালের আগেই ডিজিটাল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ১৪ নভেম্বর ২০১৭

ভিশন ২০২১ সালের আগেই ডিজিটাল বাংলাদেশ

যাযাবরের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ’- কথাটির মধ্যে আমাদের আবেগ জড়িত থাকলেও সময়ের বিবর্তনে নিজেদের প্রয়োজনেই বিজ্ঞানের গতিকে নিতে হয়েছে আপন করে। আদিমতাকে জয় করতে মানুষ তার চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে নানাভাবে। করেছে একের পর এক আবিষ্কার। আর সেই আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় যুক্ত হয়েছে এক বিস্ময়কর প্রযুক্তি যা গোটা দুনিয়াকে এনেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বশেষ বিস্ময়কর সংযোজন ইন্টারনেট। ইন্টারনেট তথ্যপ্রযুক্তির সুপার হাইওয়ে। আর এই হাইওয়ে গোটা পৃথিবীকে পরিণত করেছে একটি আধুনিক গ্রামে। পৃথিবীর প্রায় ৭ শ’ কোটি মানুষ যেন এখন একই গ্রামের বাসিন্দা। দিনরাত একে অপরকে দেখছে, করছে কথা বলাবলি। চলছে তথ্য আদান-প্রদান। খুঁজে ফিরে পাচ্ছে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ পেয়েছে গতি। আর এই গতির আলো ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রামে-দেশ থেকে দেশান্তরে। তথ্যপ্রযুক্তির এই আলো থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ। শহর থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ কৃষক শ্রমিক মজুর ভোগ করছে তথ্যপ্রযুক্তির নানা সুবিধা। মানুষের হাতের নাগালে চলে এসেছে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের ফরমসহ ১২০ থেকে ১৫০ ধরনের সেবা। এতে করে প্রতিদিন মানুষের বেঁচে যাচ্ছে কর্মঘণ্টা। আর এই কর্মঘণ্টা ব্যয় হচ্ছে উৎপান খাতে। ফলে দেশ ক্রমাগত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দূর হয়েছে অনিয়ম দুর্নীতি। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ‘বটম আপ এ্যাপরোচ পদ্ধতি’ অনুসরণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন শুরু হয় একেবারেই তৃণমূল থেকে। গ্রামে বসবাসকারী ৭০ শতাংশ মানুষ যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অনগ্রসর। তাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে গ্রামপর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট সুবিধা তৈরি করা হয়েছে। ‘জনগণের দোরগোড়ায় সেবা’ (Service at Doorsteps) -এ স্লোগানকে সামনে রেখে সারাদেশের ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয় ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি)। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এসব ইউডিসির সংখ্যা ৪ হাজার ৫৫০টি। এছাড়া স্থাপন করা হয়েছে ৭২৫টি পৌরসভা ডিজিটাল সেন্টার। এর ফলে গ্রাম-বাংলা এবং পৌর এলাকায় তথ্য ও সেবা দেয়ার প্রচলিত সনাতনী ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সহজলভ্য হয়েছে জীবন যাত্রার মান ও নাগরিক সেবা। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের ফলে সাধারণ নাগরিকগণ এখন সহজে, কম খরচে ও ঝামেলাহীনভাবে জমির পর্চা, জীবন বীমা, পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, সরকারী ফরম, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, অনলাইন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ভিজিএফ-ভিজিডি তালিকা, নাগরিক সনদ, নাগরিক আবেদন, কৃষি তথ্য, স্বাস্থ্য পরামর্শসহ প্রায় ২০০ ধরনের সরকারী-বেসরকারী সেবা ইউডিসি থেকে পাচ্ছে। মানুষের হাতের মুঠোয় বিভিন্ন তথ্য ও সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য মোবাইল এ্যাপ্লিকেশন উদ্যোগ গ্রহণ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগ ও অধিদফতরের তথ্য ও সেবার মোবাইল এ্যাপ্লিকেশন তৈরির লক্ষ্যে আইডিয়া জেনারেশন ওয়ার্কশপ চলছে। এসব আইডিয়ার মধ্য থেকে তৈরি করা হয়েছে ৬০০ মোবাইল এ্যাপ্লিকেশন। কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠা কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠার ফলে সরকারী সেবা প্রদান করা হয়েছে সহজ। আইসিটি অবকাঠামো গড়ে তোলার অংশ হিসেবে জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত কানেক্টিভিটি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বাংলাগভনেট প্রকল্পের আওতায় ৫৮টি মন্ত্রণালয়, ২২৭টি অধিদফতর, ৬৪টি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও ৬৪টি নির্বাচিত উপজেলা নির্বাহী প্রশাসকের কার্যালয় একই নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এসেছে। ইনফো সরকার-২ প্রকল্পের জেলা ও উপজেলার ১৮ হাজার ১৩০টি সরকারী অফিসের কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৮ শ’ ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। বিসিসি ভবন ও বাংলাদেশ সচিবালয় এসেছে ওয়াই-ফাইর আওতায়। সরকারী কর্মকর্তারা যাতে অফিসের বাইরে থেকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে পারে সে জন্য তাদের মধ্যে ২৫ হাজার ট্যাব দেয়া হয়েছে। এই ট্যাব বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। এতে সরকারী অফিসের কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সরকারী সেবা ও ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠার পথকে করা হয়েছে সুগম। আর এভাবেই দেশ ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সম্প্রতি এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে ৪৪তম দেশ হিসাবে বিশ্বে অবস্থান করছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভিশন ২০২১ ’র আগেই দেশ পরিণত হবে শতভাগ ডিজিটালে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অগ্রগতির বিষয়ে কথা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে। তিনি তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি নিয়ে নানা বিষয়ে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এখন মানুষের হাতের নাগালে। জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুই এখন বাস্তব। আগে যা ছিল কেবলই স্বপ্ন। শেখ হাসিনার আধুনিক চিন্তা ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের তথ্যপ্রযুক্তিলব্ধ জ্ঞান থেকে উৎসারিত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার করা হয় ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সেদিন যে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হয় তার মূল উপজীব্যই ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ। মূল কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৯ সালে। বিগত দিনগুলোতে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটে। প্রযুক্তিভিত্তিক তথ্য ও সেবা পৌঁছে যায় মানুষের দোরগোড়ায়। বিশেষজ্ঞরা তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক এই অবিস্মরণীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আখ্যায়িত করছেন ডিজিটাল রেনেসাঁ বা ডিজিটাল নবজাগরণ হিসেবে। আর এই ডিজিটাল নবজাগরণ সৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শ ও নির্দেশ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অগ্রগতি এত দ্রুত ঘটেছে, তা দেশের মানুষ এখন ভালভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অর্জন ও সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বয়ে এনেছে অনন্য সম্মান। যার প্রতিফলন দেখা যায় বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের বক্তব্যে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতিতে। ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে জিম্বাবুইয়ে থেকে শুরু করে বাংলাদেশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়েছে। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে এসব দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী দেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে।’ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বাস্তবায়িত উদ্যোগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে তুলে ধরেছে। বিগত বছরগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ওয়াচডগ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে বাংলাদেশ। সাউথ-সাউথ এ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ ভিশনারি কো-অপারেশন এ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল আইসিটি এঙলেন্স এ্যাওয়ার্ড-২০১৪, ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি-২০১৪ পুরস্কার লাভ, ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদে দ্বিতীয়বারের মতো ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিএসআইএস) পুরস্কার ২০১৫ এবং আইসিটি সাসটেনেবল এ্যাওয়ার্ড ২০১৫ অর্জন আমাদের জন্য শুধু গৌরবের নয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অভিযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাফল্য ও কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ বলেছে, দেশে যুগোপযোগী কার্যকর আইসিটি ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা উত্থাপন করা হয়েছে। পরিকল্পনার মধ্যে একটি জাতীয় ভিত্তিক কলসেন্টার স্থাপন, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ডেটা সেন্টার তৈরি, ইউনিয়ন পর্যন্ত ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, সারাদেশে দুই হাজার কম্পিউটার ও ভাষা ল্যাব স্থাপন, আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে সেবা চালু, ইনোভেশন-ডিজাইন-এক্সিলেন্স বিষয়ে একাডেমি গড়ে তোলা, কম্পিউটার কাউন্সিলের নাম বদলে আইসিটি কাউন্সিলে রূপান্তর, সফটওয়্যার সার্টিফিকেশন সেন্টার গড়ে তোলা, নতুন ব্যবসায় উদ্যোগের জন্য ইনকিউবেটর তৈরি, বৃহৎ উপাত্ত বিশ্লেষণের ব্যবস্থা ও টাইটানিয়াম ল্যাব স্থাপন করার কথা বলা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। জাতীয় ভিত্তিক কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা জাতীয় ভিত্তিক কল সেন্টার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে সর্বস্তরের জনগণের জন্য মোবাইল ফোনভিত্তিক হেল্পডেক্স কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ আগামী এক মাসের মধ্যে শুরু করা হবে। দেশের সকল নাগরিক এ কল সেন্টারে ফোন করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানুষের জীবন ও জীবিকার তথ্য জানতে পারবেন। (চলবে) লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×