ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইউনেস্কো কর্তৃক সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে ॥ রেসকোর্র্স থেকে ইউনেস্কো ॥ জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৪ নভেম্বর ২০১৭

ইউনেস্কো কর্তৃক সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে ॥ রেসকোর্র্স থেকে ইউনেস্কো ॥ জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ যে ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, ভাষণটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আমরা আগে বলতাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। আমরা এই ভাষণকে অনেক সময় তুলনা করতাম গেটিসবার্গ এ্যাড্রেসের আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাষণের সঙ্গে। কিন্তু আজকে বিশ্ববাসীর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কারণ এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি সমগ্র জাতিকে জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি।’ তিনি যদি হুকুম দিবার নাও পারেন তাহলে এই ভাষণ জাতির সামনে থাকবে এবং এই ভাষণে তিনি যা উল্লেখ করেছেন সেগুলোই আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। ভাষণে সেই নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পৃথিবীর মধ্যে একজন বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন এবং যা একবার বলতেন তার সঙ্গে কখনও তিনি আপোস করতেন না। এমনকি ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেন; কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরে যেতেন না। এর বড় প্রমাণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন-আমি বড় সৌভাগ্যবান, বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিলাম এবং তাঁর কাছ থেকে শুনেছি-তিনি বলতেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি এই পাকিস্তান বাঙালীদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালীদেরকে হতে হবে।’ সেই উপলব্ধি থেকে ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি আমাদের প্রিয় ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন-যেদিন স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই দিনটিকে বেছে নিয়ে-আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তিনি একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে জাতির সামনে তিনি ৬ দফা দাবি পেশ করেছিলেন। ৬ দফা দেয়ার পর বিভিন্ন স্থানে সভা করেছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, আবার সভা করেছেন, ফের গ্রেফতার হয়েছেন, জামিন পেয়েছেন। অনেক নির্যাতন করার পরেও থেমে থাকেননি। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান অনুভব করেছিলেন যে, তাঁর কণ্ঠ দাবানো যাবে না, তাঁকে চিরদিনের জন্য শেষ করতে হবে। সেই লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে একটি মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাবার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা জাগ্রত ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর ভিপি, জিএস এবং ৪টি ছাত্র সংগঠনের ৮ জন ছাত্রনেতা ঐক্যবদ্ধভাবে ১০ ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করি। আসাদ, মতিউর, মকবুল, রুস্তম, আলমগীর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ডঃ শামসুজ্জোহাসহ অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি যে আন্দোলন আমার শুরু করেছিলাম, ২০ জানুয়ারি আসাদকে হত্যা করার পর ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সান্ধ্য আইন জারি করে আমাদের আন্দোলনকে স্তিমিত করার চেষ্টা করেছিল আইয়ুব খান। কিন্তু পারেনি। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টনে আমরা শপথ গ্রহণ করেছিলাম এই বলে ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব, শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করব।’ আজকে বলতে ভাল লাগে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি প্রিয় নেতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির পিতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল এই বলে, ‘যে নেতা তাঁর জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, সেই নেতাকে কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হলো।’ তারপর ’৭০-এর নির্বাচন। আমরা বিজয়ী হলাম। আমি ২৭ বছর বয়সে জাতীয় পরিষদের সদস্য হলাম। এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা। সেই নির্বাচনের পর ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বঙ্গবন্ধু শপথ করিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘৬ দফা আজ আমার না, আমার দলের না। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ৬ দফা জাতীয় সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে।’ কারণ, নির্বাচনটা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন রেফারেন্ডাম হিসেবে চিহ্নিত করে। অনেকে বলেছিলেন লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে নির্বাচন করে আপনার লাভ হবে না। তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের পরে এলএফও আমি টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলব,-ও রিষষ ঃবধৎ ঃযরং খঋঙ রহঃড় ঢ়রবপবং রসসবফরধঃবষু ধভঃবৎ ঃযব বষবপঃরড়হ.’ নির্বাচনের পর তিনি তাই করেছিলেন। এরপর ১ মার্চ যখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো তখন দাবানলের মতো জাতি গর্জে উঠল। স্লোগান তুলল ‘আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব।’ পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দিল। বিক্ষুব্ধ জনতা স্লোগান তুলল ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি। ষাটের দশকে আমাদের সেই বিখ্যাত স্লোগান ‘জাগো জাগো বাঙালী জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এসব স্লোগানে আমরা রাজপথ মুখরিত করলাম। ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টনে বঙ্গবন্ধুকে সামনে নিয়ে শপথ গ্রহণ করল। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার ছাত্রনেতা ছিলেন আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। বঙ্গবন্ধু সেদিনই ঘোষণা দিলেন ৭ মার্চ জাতির উদ্দেশে তিনি ভাষণ দেবেন। আমাদের জীবনে এলো ৭ মার্চ। সেদিন ছিল রবিবার। সকাল থেকেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সরগরম ছিল। পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী বেলা ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সভামঞ্চে এলাম ৩টা ১৫ মিনিটে। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করেন ৩টা ৩০ মিনিটে এবং ১৮ মিনিটের একটি বক্তৃতা দিলেন, যা ঐতিহাসিক যুগান্তকারী। বঙ্গবন্ধুর সামনে দুটি পথ খোলা ছিলÑ একদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত না হওয়া, অপরদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা। শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে শুনেছি, ৬ তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু পাঁয়চারী করেছেন এবং ভেবেছেন কী বলবেন! এটা কোন লিখিত বক্তব্য ছিল না। এই বক্তৃতাটি ছিল তাঁর হৃদয়ের গভীরে যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। শ্রদ্ধেয়া ভাবী অর্থাৎ বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেছিলেন, ‘তোমার এতো চিন্তার কারণ কী? সারা জীবন তুমি একটি লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তোমার জীবনের যৌবন তুমি কারাগারে কাটিয়েছ, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ, তুমি যা বিশ্বাস করো সেই বিশ্বাস থেকেই আগামীকাল (অর্থাৎ ৭ মার্চ) বক্তৃতা করবে।’ ঠিক সেই বিশ্বাস নিয়েই তিনি বক্তৃতা করেছেন। মঞ্চে যখন বঙ্গবন্ধু উঠলেন আমরা স্লোগান দিলাম, আমি নিজেই স্লোগান দিলাম। বঙ্গবন্ধুর নাম যখন ঘোষিত হলো তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালেন-আপনারা জানেন সেই ৭ মার্চের ভাষণ-‘ভাইয়েরা আমার’ বললেন। বঙ্গবন্ধুর বৈশিষ্ট্য ছিল যেখানেই জনসভা করতেন বাংলার মানুষকে হৃদয়ের গভীরতা থেকে অন্তরের সঙ্গে সম্বোধন করতেন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে। জনসভার উত্তাল তরঙ্গ, সমুদ্রের গর্জনের মতো শব্দ মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যেত। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ, লোকে লোকারণ্য। কারোর হাতে বৈঠা, কারোর হাতে কৃষকের লাঙলের ফলা, শ্রমিকের হাতে লাঠি। তিনি যখন বক্তৃতা শুরু করলেন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে পিনপতন নিস্তব্ধতা চারদিকে। তার মধ্যে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি রাখলেন। কাছে থেকে আমাদের মনে হয়েছিল এই দিনটির জন্যই তো বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা করছিলেন। সুন্দর একটি বক্তৃতা তিনি রাখলেন। খুব সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন, অপরদিকে যাতে তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করতে না পারে সে ব্যাপারে তিনি সজাগ ছিলেন। বক্তৃতার মাঝখানে তিনি চারটি শর্ত আরোপ করে দিলেন। মার্শাল ল প্রত্যাহার করো, সেনাবাহিনী ব্যারাকে নিয়ে যাও, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করো এবং গত কয়েকদিনে যে হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করো। এই ৪টি শর্ত দিয়ে বোঝালেন যে, তিনি পাকিস্তান ভাংতে চান না। তারপরই বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা কথা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করলেন। অলিখিত এই ভাষণে সারা জীবন যার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সেই স্বাধীনতার কথা তিনি হৃদয়ের গভীর থেকে বলেছিলেন। তারপর যখন বললেন, ‘ওদেরকে ভাতে মারব, পানিতে মারব’-সব কথা তিনি বললেন। অর্থাৎ একটা মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে হয়, একটা গেরিলা যুদ্ধ কিভাবে সংঘটিত করা যায়-তার সমস্ত দিকনির্দেশনা তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ করলেন এই কথা বলে যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। সুতরাং, এই ভাষণটা যে একদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদা পাবে এই আস্থা এবং বিশ্বাস আমাদের ছিল। আজকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। পৃথিবীর কোন ভাষণ কোন দেশে এতবার উচ্চারিত হয়নি। অথচ একদিন এই ভাষণ আমরা বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকীতে বাজাতে পারিনি। তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার আমাদের মাইক কেড়ে নিয়ে গেছে। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমনকি ৭ মার্চেও আমরা এই ভাষণ বাজাতে পারিনি। যখন ’৯১তে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছেন তখন নির্যাতন চলেছে এবং এই ভাষণ আমাদের বাজাতে দেয়নি। তার আগে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আমরা যখন কাঙালী ভোজ করতাম, শহরের প্রত্যেকটা জায়গায় আমরা যেতাম, সেখানে ৭ মার্চের ভাষণ তারা আমাদের উচ্চারণ করতে দিত না। মনে পড়ে ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত শত শহীদের রক্ত¯œাত মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ’৯৩-এর ৭ মার্চ দাবি তুলে বলেছিলাম, ‘মাননীয় স্পীকার, আপনি জানেন যে, আজকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। এইদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছিলেন-যার উপরে ভিত্তি করে ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে আমরা আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। আজকে সেই ৭ মার্চে বিভিন্ন মহল থেকে আপনি জানেন, এই দিনটিকে পালন করার জন্য আমরা অনুরোধ করেছিলাম। রেডিও, টিভিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচী হয়। এমনকি মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেবেরও জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচী হয়ে থাকে, অন্যান্য কর্মসূচী হয়ে থাকে। এই ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই, মিস্টার স্পীকার। কিন্তু আজকে ৭ মার্চের কোন কর্মসূচী আমাদের টিভি, আমাদের রেডিও কোন জায়গায় নেই। এটা উপেক্ষিত। এর সঙ্গে সঙ্গে যারা স্বাধীনতাবিরোধী তারা এই সুযোগে স্বাধীনতার ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এই স্বাধীনতার ইতিহাসকে ম্লান করছে। আমরা ভেবেছিলাম যে, একটা নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে এই স্বাধীনতার ইতিহাসকে তারা সমুন্নত রাখবে। আমাদের তিন জোটের রূপরেখা, সেই ঐতিহাসিক ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, স্বাধীনতার মূল্যবোধকে আমরা যে কোন প্রকারেই রক্ষা করব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তব যে, এটাই সত্য যে, আজকে এই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে, এই ৭ মার্চ পালন করা হচ্ছে না। যে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, সেই দিন পালন করা হচ্ছে না। এই ব্যাপারে আজকে আমরা এই সংসদে দাঁড়িয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ করছি এই কারণে যে, এই ৭ মার্চ জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ৭ মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন যে, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সামনে রেখে, ৯ মাস যুদ্ধ করে যে দেশ আমরা স্বাধীন করেছি, সেই দেশে আজ পতাকা আছে, জাতীয় সঙ্গীত আছে, নেই সেই স্বাধীনতার মূল্যবোধ। আজকে রেডিও-টিভিতে নেই সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যেই ভাষণ আমাদের ৯ মাসের যুদ্ধের প্রেরণা যুগিয়েছিল। তাই আজকে এর তীব্র প্রতিবাদ করছি এই সরকারের কাছে, এই সংসদে দাঁড়িয়ে এখনও আমি অনুরোধ করছি, যাতে আজকে রাতের বেলায় টিভিতে যে অনুষ্ঠান হবে সেই অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ যেন প্রচার করা হয়। দেশবাসীকে জানানো হয়, যাতে নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাসকে জানতে পারে।’ আজ এই ভাষণ শুধু বাংলাদেশেরই শ্রেষ্ঠ ভাষণ না, আন্তর্জাতিক বিশ্বে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্ত, চার লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, ইতিহাসের মহামানব, পৃথিবীর নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে শ্রেষ্ঠ নেতা আজ ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ২৭ অক্টোবর এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন এবং ৩০ অক্টোবর প্যারিসে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তা ঘোষণা করেন। আজ আমরা গর্ববোধ করি। আজ জাতির জনক নেই, তিনি টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমিয়ে আছেন। এই বাংলাদেশ তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশ তাঁর রক্তে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের জন্যই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই বাংলাদেশের জন্যই তিনি জীবনের যৌবন তথা ৪,৬৮২ দিন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছে। তিনিও আজ শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। ৭ মার্চের ভাষণের মূল চালিকাশক্তিই ছিল নিরস্ত্র বাঙালীকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করা। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যেতাম,-সেই দেরাদুনে আমাদের মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং হতো-আমরা বক্তৃতা করতাম, ‘প্রিয় নেতা আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানি না; যতক্ষণ বাংলাদেশকে আমরা হানাদারমুক্ত করতে না পারব প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ ১৬ ডিসেম্বর দেশকে হানাদারমুক্ত করে আমরা মায়ের কোলে ফিরে এসেছিলাম। আজ ইউনেস্কো কর্তৃক ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বসভায় স্বীকৃতির এই গৌরবের দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার [email protected]
×