ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রুবেল রেহান

গোলাপে সুবাসিত জীবন

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১৩ নভেম্বর ২০১৭

গোলাপে সুবাসিত জীবন

বলা হয় What‘s in name আর বাংলায় কবি বলেন, ‘গোলাপ যে নামেই ডাকো’...। আরও বলা হয়, জোটে যদি একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ জোটে যদি দুইটি পয়সা ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী...। ফুল ভালবাসেন না এমন মানুষ বিরল। ফুলের রানী গোলাপ, সেই অর্থে গোলাপকে মানবিক হৃদয়ের রানীও বলা যায়। গোলাপ ছাড়া এখন অসম্পূর্ণ থেকে যায় যে কোন উৎসব। অসম্পূর্ণ থেকে যায় প্রেম নিবেদন। কাজেই গোলাপের চাহিদা এখন বাজারে বেড়েই চলছে। এই চাহিদাকে সামনে রেখেই গড়ে ওঠেছে বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষের প্রকল্প। এ প্রকল্প যেমন ভাগ্য বদলে দিয়েছে উৎপাদনকারীর তেমনি রীতিমতো বদলে দিয়েছে এলাকার পরিচয়। ঢাকার পাশেই বিরুলিয়ার এমন একটি গ্রাম হয়ে ওঠেছে গোলাপ গ্রাম। নামেই পরিচয়। বাস্তবতাও নামের সমর্থনে কথা বলে। গ্রামের মেঠো রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেদিকেই চোখ মেলি কেবল গোলাপ আর গোলাপ। এ যেন রংয়ের মেলা। প্রকৃতি খুলে বসেছে তার রূপের হাট। পথচারীকে স্বাগত জানায় তার সৌরভ, সৃষ্টি করে মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশের। এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ছুটে আসে গোলাপের সান্নিধ্য পাবার আসায়। প্রকৃতিপ্রেমীরাই যে এখানে আসেন তা নয়, প্রকৃত প্রেমিকও আসেন। গোলাপের রাজ্যে হৃদয়ের নিবেদন নিঃসন্দেহে এক অন্যরকম অনুভূতি। কার সাধ্যি সে নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে! গোলাপ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পেশাই গোলাপ চাষ। যার যতটুকু জায়গা আছে তাতেই করেছেন গোলাপের বাগান। আর এ গোলাপের চাষ যে বিরুলিয়াতেই সীমাবদ্ধ তা নয়। বিরুলিয়া পথ দেখিয়েছে আশপাশের অন্য গ্রামগুলোকেও। বিরুলিয়ার দেখাদেখি সাদুল্লাপুর, কমলাপুর, বাগ্নিপুর, শ্যামপুরের মানুষও তাদের ভাগ্য বদলে নিয়েছেন গোলাপ চাষে। গোলাপ চাষকে ঘিরেই তাদের জীবন। এই গোলাপের গল্প জানতেই ছুটে যাওয়া গোলাপের দেশে। কথা হলো গোলাপ চাষী মোঃ শহিদের সঙ্গে। শুরুটা ১২-১৫ বছর পূর্বে। অন্যদের মতো তিনিও তার দুই পাকি (প্রায় ৩০ শতাংশ) জমিতে চাষ করছেন গোলাপের। চাষ করেন মিড়ান্ডা প্রজাতির গোলাপ। আর তখন থেকেই তার পেশা গোলাপ চাষ। প্রতিদিনই গোলাপের জমিতে কাজ করেন। আর দুপুরের পর শুরু হয় ফুল তোলা। সন্ধ্যার মধ্যে ফুল তোলা শেষ করে নিয়ে যান পাশের ফুলের বাজারে। ঢাকা থেকে পাইকাররা সেখানে আসেন ফুল কিনতে। এছাড়াও এলাকার কিছু পাইকার আছে যারা ফুল কিনে তা পরদিন সকালের মধ্যে ঢাকার শাহবাগ, ফার্মগেট অথবা আগারগাঁও ফুল বাজারে বিক্রি করেন। ঠিক কীভাবে, কততে হয় কেনাবেচা জানতে চাইলে মোঃ শহিদ বলেন, তারা ফুল বিক্রি করেন বান্ডেল হিসেবে। প্রতি বান্ডেলে ফুল থাকে ৩০০ পিস। এক বান্ডেলের বিক্রয় মূল্য ১৫০০-২০০০ টাকা। আর এর পেছনে খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার দুই পাকি (৩০ শতাংশ) জমিতে এক সিজনে খরচ হয় প্রায় এক লাখ টাকা। তা থেকে সারাবছর আয় করেন সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। তবে তিনি এও জানালেন যে, খরচটা মূলত এক সঙ্গে হয়। আর আয় হয় ধাপে ধাপে- প্রতিদিনের বিক্রি থেকে। তার এ দুই পাকি জমি থেকে এখন প্রতিদিন ফুল তোলেন প্রায় আড়াই বান্ডেল (প্রায় সাড়ে সাত শ’)। অফ সিজন হওয়ায় এখন ফুল ফোটে কম। আর সিজনের সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২-১৩ বান্ডেল (অর্থাৎ ৩৬০০-৩৯০০)। দাম তখন কিছুটা কম পাওয়া যায়। তবে বিভিন্ন উৎসবের সময় দাম হয় আকাশচুম্বী। যদিও সে দামের সুবিধা চাষীরা তেমন পান না। অতিরিক্ত লাভের প্রায় পুরোটাই চলে যায় শহুরে বিক্রেতাদের পকেটে। আর এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপও ঝরল মোঃ শহিদের কণ্ঠে। তবে শহিদের কাছে জানা গেল এ অঞ্চলে গোলাপ চাষের শুরুটা হয়েছিল প্রায় ২৫-৩০ বছর পূর্বে। রমজান আলী। নিজের বাড়ি দিনাজপুরে। অনেক বছর থেকেই থাকেন বিরুলিয়ায় একটি ভাড়া বাড়িতে। তাকে বলা যায় গোলাপ শ্রমিক। সারাদিনই তিনি কাজ করেন গোলাপ বাগানে। কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণ কথা হলো তার সঙ্গে। জানা গেল, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জমির পরিচর্যায় কাজ করেন। বিকেলের দিকে শুরু করেন ফুল তোলা। সন্ধ্যার পর শ্যামপুর ফুল বাজারে বিক্রি করে টাকা বুঝিয়ে দেন তার মালিকের হাতে। গোলাপকে ভালবেসে গোলাপের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে নেয়া এ মানুষগুলো আছেন শঙ্কায়। নগরায়নের বিস্তৃতি সঙ্কুুচিত করছে তাদের চাষের জমি। জমি হারাচ্ছেন বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য। জমির উচ্চ মূল্যতে অনেকেই অর্থের প্রলোভনে ত্যাগ করছেন দীর্ঘদিনের পেশা। এখন দেখার বিষয় সভ্যতার করাল গ্রাসে এই গোলাপের জমি কী হয়ে ওঠবে এক ইট কাঠের জঞ্জাল! নগরায়ন গ্রাস করছে প্রকৃতিকে নেই তা রক্ষায় কোন যথার্থ পরিকল্পনা। এর শেষ কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে নীরবে দুচোখ তুলে দিগন্তে তাকিয়ে রইলেন গোলাপ চাষী শহিদ।
×