ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

রোহিঙ্গাদের শীঘ্র দেশে ফেরা হচ্ছে না ॥ ইকোনমিস্ট

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৩ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের শীঘ্র দেশে ফেরা হচ্ছে না ॥ ইকোনমিস্ট

সম্প্রতি ‘দি ইকোনমিস্ট’ সাময়িকীতে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ওপর প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের শিবিরগুলোতে যে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তারা এত শীঘ্র এ দেশ থেকে চলে যাবে না। নিবন্ধে বলা হয়, কুতুপালং শরনার্থী শিবির অস্থায়ীভাবে মনে হচ্ছে না। সেখানে বাঁশ ও প্লাস্টিকের তৈরি হাজার হাজার তাঁবু আছে। দলে দলে পুরুষ শরণার্থীরা আরও তাঁবু খাটানোর জন্য কাঁধে করে লম্বা লম্বা বাঁশ নিয়ে আসছে। মাছ, সবজি, ফল বাজারে বিক্রি হচ্ছে। অর্ধনগ্ন শিশুরা বাইরে দোকান সাজিয়ে বসেছে। বিক্রি করছে মিষ্টি ও বিস্কুট। অন্যরা কর্দমাক্ত জলাশয়ে লুটোপুটি করছে। খাল বা জলাশয় দ্বারা বিভক্ত শিবিরগুলোর মধ্যে সংযোগ সাধন করেছে লম্বা বাঁশের সাঁকো। গত আগস্ট মাসে এই কুতুপালং শিবিরে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ছিল। এখন এদের সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। গত আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য হতে সেনা হামলা ও নিষ্ঠুরতার মুখে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের এক শীর্ষ মানবাধিকার কর্মকর্তার ভাষায় এ হলো জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। গত ১৬ অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সে দেশের সিনিয়র কর্মকর্তাদের ইউরোপ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারে বাণিজ্য মিশন পাঠানোও বন্ধ রাখে। তথাপি বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও ধিক্কার সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন অব্যাহত আছে। শুধু গত ১৬ অক্টোবরেই এসেছে ১২ হাজার রোহিঙ্গা। সঙ্গে নিয়ে এসেছে বিভীষিকার নানা লোমহর্ষক কাহিনী। ইব্রাহিম নামে ১০ বছরের এক কিশোরের কথাই ধরা যাক। তার কাছ শোনা যাবে কিভাবে বর্মী সেনারা তার বাবাকে মেরে ফেলেছিল। পরে, তার বাবার লাশ খুঁজতে গিয়ে দেখে বর্মী চরমপন্থীরা লাশগুলোর মাথা ধর থেকে কেটে ছিন্ন করছে। বর্তমান শিবিরগুলোর মধ্যে নয়াপাড়া ও কুতুপালংই সবচেয়ে বড়। নতুনদের জায়গা দিতে গিয়ে সেগুলো আরও স্ফীত হয়েছে। ধানক্ষেতের প্রান্তে বা বর্তমান শিবিরগুলোর উপকণ্ঠে গজিয়ে উঠেছে নতুন নতুন ছাউনি। জায়গাগুলোর অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই শোচনীয়। বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও চিকিৎসার যথেষ্ট অভাব। শরণার্থীরা রেশনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টি হলে অবস্থা আরও দুর্বিষহ হয়। শিবিরগুলো কাদায় ভরে যায়। অপুষ্টির শিকার শিশুরা ক্যাম্পগুলোর মাঝামাঝি জায়গায় বিচরণ করে বেড়ায়। ডায়রিয়া ও চর্মরোগ তো লেগেই আছে। এমনকি মহামারী আকারে কলেরা লেগে যাওয়ারও আশঙ্কা আছে। শরণার্থী মহিলাদের প্রতি তিনজনের একজন গর্ভবতী। মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ারেস নামে চিকিৎসা বিষয়ক একটি সাহায্য সংস্থার প্রায় এক হাজার সদস্য বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কাজ করছে। এই সংস্থার জরুরী পরিস্থিতির সমন্বয় বিভাগের প্রধান রব ওনাস বলেন, সমস্যার একটা দিক হলো ভৌগোলিক অবস্থা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ইরাক বা সিরিয়ার মতো সমতল মরুভূমির দেশের মতো নয়। বরং এলাকাটি পাহাড় ও টিলাময়। এখানে গুদাম নির্মাণ করা কঠিন। সেরা জমিগুলো ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি ও অন্যান্য ইমারতে ছেয়ে গেছে। যেটুকু বা অবশিষ্ট আছে তা অসমতল, বন্যাপ্রবণ ও গাছপালায় আকীর্ণ। কোনভাবে যদি গুদাম তৈরি করা যায়ওবা সেখান থেকে খাদ্য বা ওষুধপত্র উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে নিয়ে যাওয়া বড়ই কঠিন। কারণ, শিবিরগুলোতে যাওয়ার পথ এতই দুর্গম যে গাড়িতে করে যাওয়া সম্ভব নয়। সাহায্যকর্মীদের কর্দমাক্ত পথ, বাঁশের সাঁকো ও খাঁড়া ঢাল দিয়ে চলাফেরা করতে হয়। শিবিরগুলোর আকার এবং অবস্থানও আরেক সমস্যা। শরণার্থীদের মধ্যে যারা রাস্তার কাছাকাছি থাকে তারা হয়ত চিকিৎসা পাবে। কিন্তু যারা আরও ভেতরের দিকে থাকে তাদের যে শুধু তা পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম তাই শুধু নয়। সেই সুযোগ যে আছে তা হয়ত তারা জানেও না। ইকোনমিস্টের নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এখানে আসার সুযোগ দিয়ে অসাধারণ ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শরণার্থীদের প্রতি কেমন আচরণ করা হবে সে ব্যাপারে এক মিশ্র সঙ্কেত বার্তাও দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে এই সরকার বদ্ধপরিকর বলে মনে হয়। অক্টোবরের প্রথমদিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা প্রণয়নে বাহ্যত একমত হয়। তবে প্রত্যাবর্তনের শর্তাবলী সম্পর্কে শীঘ্রই মতৈক্যে পৌঁছার সম্ভাবনা কম। সরকার কুতুপালংয়ে একটা ‘মেঘা ক্যাম্প’ তৈরি করার কিংবা বন্যাপ্রবণ কোন দ্বীপে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের কথাও বলেছে। অতীতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের দৃষ্টান্তগুলো উদ্বেগজনক। ১৯৭৮ সালে এবং পরে ১৯৯১ সালে এ দেশে রোহিঙ্গাদের ব্যাপকহারে আগমন ঘটে ছিল। পরবর্তীকালে তাদের যখন স্বদেশ ফেরত পাঠানো হয় সেটা যত না ছিল ঐচ্ছিক তার চেয়ে বেশি ছিল জবরদস্তিমূলক। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে তৎকালীন জাতিসংঘ শরণার্থী শাখার প্রধান এলান লিন্ডকুইস্টের এক রিপোর্টে বলা হয় সে সময় বাংলাদেশ সরকারের গোড়া থেকেই একটা লক্ষ্য ছিল এই যে ‘রোহিঙ্গারা’ যে যাই ভাবুক না কেন তাদের যত দ্রুত সম্ভব বর্মায় ফিরে যেতে হবে। ওই সময় স্বদেশ প্রত্যাগত রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমাবদ্ধ করা এবং খাদ্যের রেশন সময়মতো না পৌঁছাতে পারায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রায় ১১ হাজার ৯শ’ রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করেছিল। বাংলাদেশে অন্তত পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গারা বলেছে যে, ২০০৬ সালে সরকার এনজিওগুলোকে আরও অবাধে কাজ করতে দেয়ার পর থেকে তাদের জীবনের নাটকীয় উন্নতি ঘটেছে। অনেকে শিবির থেকে চলে গেছে। কেউ কেউ বাংলাদেশী নাগরিকত্ব লাভ করেছে। কেউ কেউ ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও নেপালে পাড়ি জমিয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করা ছাড়াও বর্তমান রোহিঙ্গা সঙ্কট বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরও ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। রাস্তার পাশের পোস্টারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতার জননী বা ‘রোহিঙ্গাদের আশা’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তবে সরকার এখনও শরণার্থী শব্দটা ব্যবহার করতে নারাজ। বরং সরকার তাদের জোরপূর্বক বিতাড়িত মিয়ানমারের অধিবাসী বলে আখ্যায়িত করার পক্ষপাতী। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা তাদের আবাসভূমিতে ফিরে যেতে চায়। তারা তাদের সেই বাড়িঘরের কথা বলে যেখানে তারা থাকত। সেই জমিজমার কথা বলে যার মালিক ছিল তারা এবং সেই চিংড়ি ঘেরের কথা বলে যেখানে তারা চিংড়ি চাষ করত। কিন্তু সেই ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রহেলিকা হয়েই থেকে যাওয়ায় তাদের সঙ্গে ফিলিস্তিনীদের ভাগ্যের মিল তাৎক্ষণিকভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×