ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ নানামুখী বিপর্যয়ে চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১৩ নভেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ নানামুখী বিপর্যয়ে চট্টগ্রাম

বঙ্গোপসাগরের তীরে পাহাড় নদী ঘেরা প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য চট্টগ্রাম। পাহাড়, সমুদ্র আর নদীবেষ্টিত একটি সুন্দর শহর শুধু নয়, এটি একটি জেলা ও বিভাগীয় শহর। ছোট-বড় পাহাড়, টিলা নিয়ে গড়ে ওঠা এ শহর খুবই সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন। ছিল অনুকূল পরিবেশ। প্রাচ্যের রানীখ্যাত এই চট্টগ্রামকে এখন আর এই নামে ডাকা যায় না। চট্টগ্রামের সেই বৈচিত্র্য ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। গবেষকদের মতে প্রায় দুই হাজার বছর আগে বন্দর শহর চট্টগ্রামের গোড়াপত্তন। পরিবেশবাদীদের মতে, বাংলাদেশের প্রকৃতির অন্যতম উপাদান নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, পাহাড়, বন ও বন্যপ্রাণী ইত্যাদি মিলে গড়ে ওঠে প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, বন ও বন্যপ্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নেমে আসে বিপর্যয়। প্রকৃতিতে এদের ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে প্রতিনিয়ত এসব উপাদান ধ্বংস হচ্ছে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগে বন ধ্বংস, পাহাড় নিধন, অবৈধ বন্যপ্রাণী শিকার, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প-কারখানার দূষণে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। বনভূমি উজাড়ের পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর দাবদাহে যতটা পরিবেশের ক্ষতি হয় তার চেয়ে শতগুণ বেশি হয় মানবসৃষ্ট কারণে। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা জনশ্রুতি রয়েছে, পাহাড়ী অঞ্চলের সালদা গ্রামের সালদা নামক ছড়া থেকে হালদার নামকরণ। হালদা নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ দেশেই উৎপত্তি হয়ে এ দেশেই শেষ হয়েছে। সে হিসেবে এ নদী সম্পূর্ণরূপে আমাদের। প্রায় ১০০ কিমি দৈর্ঘ্যরে হালদা নদীতে মিলিত হয়েছে ৩৬টি ছড়া। এর মধ্যে খালের সংখ্যা ১৯টি। ১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ নদীর ২৯ কিলোমিটার অংশ সারা বছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। প্রতিবছর হালদা নদীতে বর্ষার ঘনবৃষ্টির অমাবস্যার রাতের একটি বিশেষ মুহূর্তে রুইজাতীয় মাতৃমাছ ডিম ছাড়ে। কার্পজাতীয় মাছের উৎকৃষ্ট প্রজনন ক্ষেত্র এ হালদা নদী। স্থানীয় জেলেরা ডিম ছাড়ার তিথির আগেই নদীতে অবস্থান নেন। ডিম দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে। জোয়ার-ভাটার নদী থেকে সরাসরি ডিম আহরণের এমন নজির পৃথিবীতে বিরল। হালদা নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয়, এটি যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বিশাল উৎস। এই হালদা নদী থেকেই চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে চট্টগ্রাম মহানগরের ৬০ লাখ মানুষের পানির চাহিদা মেটায়। রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ পোনার জন্য এ নদীর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বাঁক কাটা, বালি উত্তোলন, ইটভাঁটি নদীর মাটি ও পানি ব্যবহার, রাবার ড্যাম স্থাপন, নদীর তীরে তামাক চাষ ও যন্ত্রচালিত নৌযান থেকে তেল ছড়িয়ে পড়া, মা-মাছ নিধন, এত সব মানবসৃষ্ট দূষণসহ নানা কারণে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও চট্টগ্রামের মানুষের লাইফলাইনখ্যাত এ নদী মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে জর্জরিত এবং চরম বিপর্যয়ের মুখে। কল-কারখানা ও মানবসৃষ্ট বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা দেশের নদী দূষণের কারণ শিল্প-কারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালি ও মানব বর্জ্য। দেশের বড় ও মাঝারি ধরনের প্রায় ৮ হাজার শিল্প-কারখানা ক্ষতিকর বর্জ্য পার্শ্ববর্তী নদীগুলোতে নিঃসরণ করছে। এসব এলাকার খাল-বিল-নদী মারাত্মক দূষণের শিকার। দূষণকারী শিল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে চামড়াশিল্প, ওষুধশিল্প, রাসায়নিক সার কারখানা, টেক্সটাইল, ডায়িং এ্যান্ড প্রিন্টিং, রং-কাগজ শিল্প প্রভৃতি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয়, চট্টগ্রামের অভ্যন্তরের ৩৬টি খালের সীমানা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে এদের অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন। একদিকে অবৈধ স্থাপনা, অন্যদিকে কলকারখানার দূষিত উপাদান ও ৪৫ লাখ নগরবাসীর বর্জ্য নদী-নালা-খালের অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধস বাংলাদেশের প্রায় ১৮ শতাংশ পাহাড়ী অঞ্চল যার সিংহ ভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থিত। বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে আমাদের জনসংখ্যা অনেক আগেই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান, রাস্তাঘাট, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি তৈরি করতে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অপরিকল্পিতভাবে কাটতে হয়েছে পাহাড়। পাহাড়ে বড় গাছ নেই গাছের শেকড় প্রাকৃতিকভাবে মাটি ধরে রাখে, সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অতি বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে। যে কোন মূল্যে প্রয়োজন জীবনের স্পন্দন পানি ও অক্সিজেনের উৎসসমূহকে সুরক্ষিত রাখা, প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়া, বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সবুজ বন সৃজন করা সময়ের দাবি। প্রকৃতিকে পরিমিত শাসন সভ্যতার ক্রমবিকাশের জন্য অপরিহার্য। মৃতপ্রায় নগরের খাল-বিল ১৯৬৯ সালের মাস্টারপ্ল্যান ও আরএস সিট অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরে ছোট-বড় খাল ছিল ৭০টি। কিন্তু বর্তমানে ৪৬টি খালই অস্তিত্বহীন। একসময় চট্টগ্রাম বন্দর চালু হওয়ার আগে মহেশখালে বিদেশী জাহাজ ভিড়ত যথারীতি পণ্যদ্রব্য খালাসও হতো। কোথায় সেই মহেশখাল? মহেশখালকে আমরা নিঃশেষ করে দিয়েছি, যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করেছি। ফলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। নাগরিকরা যতক্ষণ পর্যন্ত এটির ভয়াবহতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সেবা সংস্থার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয় জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে এ শহরকে রক্ষা করা। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পগ্রহণ প্রাকৃতিক খালসমূহ হতে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, খালসমূহের দুই পাশে দখলকৃত সরকারী জায়গা উদ্ধার, খালসমূহ হতে মাটি উত্তোলন, খাল খনন ও ভরাটকৃত খালের মাটি এবং আবর্জনা নিষ্কাশন করে খালসমূহের স্বাভাবিক প্রবাহ অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ অবৈধ দখলদার বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া এবং নিয়মিত মনিটরিং করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিশেষে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে টাক্সফোর্সের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ, নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মোটিভেশনাল ক্যাম্পেন, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহের পাহাড় সুরক্ষা, নির্বিচারে পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধ করা, কর্ণফুলী নদী খনন করে নাব্য ফিরিয়ে আনা, হালদা নদী থেকে অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন বন্ধ করা, জেলা ও নগরের দখল হয়ে যাওয়া শতাধিক খাল বিল নালা উদ্ধার করে খননের উদ্যোগ গ্রহণ, খালগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা, কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত খালগুলোর মুখে স্লুইসগেট বা জলকপাট নির্মাণ, নগরজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরিতে আইনের সঠিক প্রয়োগ করা সম্ভব হলে এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে চট্টগ্রাম শহর স্থায়ীভাবে মুক্ত হবে। আসুন, সবাই মিলে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে চট্টগ্রামের জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতির রানীখ্যাত ও বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম শহরকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। লেখক : কো-অর্ডিনেটর ও শিক্ষক প্রতিনিধি আগ্রাবাদ সরকারী কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
×