ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদ্বেষের আগুন

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ১৩ নভেম্বর ২০১৭

বিদ্বেষের আগুন

বিদ্বেষের আগুনে পুড়ে গেল রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রামের কিছু ঘর। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর আরেকটি নিন্দনীয় হামলার ঘটনা ঘটল। সেই একই পুরাতন গল্প! ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দলবদ্ধ আক্রমণ এবং জ্বালাও-পোড়াও-ভাংচুর। লুটতরাজও করা হয়েছে। এবারও আক্রমণের সূত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুকে কথিত একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার মতো সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক বিনাশকারী কর্মকা- পুনরায় ঘটানো হলো। এটাই কি আমাদের সামাজিক বাস্তবতা? কবে শেষ হবে এ জাতীয় গ্লানিকর কর্মকা-? দুঃখজনক হলো, এই ধ্বংসাত্মক ও বিভেদমূলক মন-মানসিকতা থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না সমাজ। অথচ সব ধর্মেরই মূল কথা হলো শান্তি। কোন ধর্মেই কোন রকমের বাড়াবাড়িকে উৎসাহিত করা হয়নি। আমরা স্মরণ করতে পারব কয়েক বছর আগে রামুতে একইভাবে ফেসবুকের একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ হয়েছিল। একইভাবে গত বছর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় হয়েছিল হিন্দুদের ওপর আক্রমণ। এই দেশের মাটিতে একাত্তর সালেই বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ওপর চূড়ান্ত বর্বর আচরণ হয়েছিল, আর তার উদ্যোক্তা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালী সেনাবাহিনী। পাকিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সেই অন্যায় পরিচালিত হয়েছিল। বলা দরকার, তাদের সহযোগিতা করেছিল কিছু বাঙালী যারা মুসলমান বলে পরিচয় দিলেও মূলত তারা ছিল ধর্মব্যবসা বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতিভূ। স্বাধীন দেশে ধর্ম বিচারে জাতিবৈর কখনই বড় নেতিবাচক উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, হিন্দুদের ওপর যত আক্রমণ হয়েছে তার প্রায় সবগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের নীতি, ধর্ম সেখানে কোন অনুঘটক নয়। যদিও ধর্মীয় উপাসনালয়ে আগুন দেয়া হচ্ছে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হচ্ছে, লুটপাট হচ্ছে তাদের ব্যবসাকেন্দ্রে। মানুষের ভেতরে এখনও মনুষ্যত্ববিরোধী উপাদান রয়ে গেছে এবং ধড়িবাজ কিছু ব্যক্তি সেটা উস্কে দিয়ে মানব-ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করে চলেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা ঠাকুরপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন। রংপুরের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করুক, এটা প্রত্যাশিত। শুধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য কৌশলে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তদন্ত কমিটি সেটি খতিয়ে দেখবে বলে মানুষ আশা করে। ধর্মীয় সহনশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য যে দেশের মানুষের সুনাম রয়েছে সেখানে কোনভাবেই অল্প ক’জন উগ্রবাদী ধুরন্ধর মানুষের জন্য তা বিনষ্ট হতে দেয়া যায় না। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। ঠাকুরপাড়া গ্রামে কর্তব্য পালনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলা হয়েছে। হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, যা দুঃখজনক। এদেশের মানুষ কোন ধর্ম সম্পর্কেই কোন ধরনের কটূক্তি পছন্দ করে না। তাই অবশ্যই এটি পরিত্যাজ্য। ফেসবুকের মতো ভার্চুয়াল মাধ্যমে, যা একটি চাবি টিপেই অদৃশ্য করা বা মুছে ফেলা সম্ভব, সেই মাধ্যমের কোন ছবি বা পোস্টকে কেন্দ্র করে একটি সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর ঢালাও এবং ব্যাপকভাবে আঘাত হানার কাজটি অত্যন্ত নিন্দনীয়। এহেন নিন্দনীয় কাজ কোন বিবেকসম্পন্ন মানুষের পক্ষে কি করা সম্ভব? আমরা আশা করব ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টকারী যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণকারীকে নিরুৎসাহিত করার মতো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সর্বত্র সজাগ থাকবে। একইসঙ্গে দেশের প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে কেউ যদি ধর্ম অবমাননামূলক তৎপরতা চালিয়ে অপরাধ করে, তবে তার বিচারও আইন অনুযায়ীই হতে হবে। মোট কথা ধর্মবিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরির কাজটিকে যে কোন মূল্যেই আমাদের প্রতিহত করতে হবে।
×