ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুরের ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দাবি

সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১২ নভেম্বর ২০১৭

সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রামু ও নাসিরনগরের আদলে মিথ্যা অভিযোগ তুলে রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেছে উগ্র-সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পিত হামলাকারীদের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনরা। শুক্রবার রংপুরে হামলার প্রতিবাদে শনিবার রাজধানীতে মানববন্ধন, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচী করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। এছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে পৃথক পৃথক বিবৃতি দেয়া হয়েছে। বিবৃতি ও কর্মসূচীতে বিশিষ্টজনরা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, নাসিরনগরের রসরাজের মতো রংপুরে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত টিটুও নিরক্ষর, অশিক্ষিত। তাছাড়া তিনি এলাকায় থাকেন না প্রায় সাত বছর। ধার দেনার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তি বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছেন। তার নামে ভুয়া ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খোলে পরিকল্পিতভাবে এ হামলার ঘটনা ঘটনানো হয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে মৌলবাদী গোষ্ঠীর এরকম হামলা রুখে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। নির্মূল কমিটি ॥ ফেসবুকে তথাকথিত ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। শনিবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ ও উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি গত ৫ বছর ধরে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হামলা চালাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় গত ১০ নবেম্বর রংপুরের পাগলাপীর ঠাকুরবাড়ি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলা, গৃহে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত টিটু রায় আদৌ ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর কিছু পোস্ট করেছে কিনা, এ অভিযোগের তদন্ত হওয়ার আগেই এলাকায় সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর প্রধান উদ্দশ্যে হচ্ছে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য ও ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারকে বিব্রত করা এবং বাংলাদেশকে মোল্লা উমরের আফগানিস্তান আর জিয়াউল হকের পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাসী ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ২০১২ সালে কক্সবাজারের বৌদ্ধদের ওপর এবং ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলার জন্য যেভাবে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অজুহাত তৈরি করা হয়েছিল একই পদ্ধতিতে রংপুরের পাগলাপীর ঠাকুরবাড়ি গ্রামে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়েছে। রংপুরে হামলাকারীদের প্রতিরোধের সময় পুলিশের গুলিতে একজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অতীতে এ ধরনের হামলার সময় আমরা দেখেছি প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামায়িকভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও এসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ‘আমরা অবিলম্বে রংপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানাচ্ছি। এসব হামলাকারীদের বিচার ও শাস্তি না হলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুু ধর্মীয় সম্প্রদায় অধ্যুষিত জনপদে আমরা এরকম আরও হামলার আশঙ্কা করছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য।’ বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে রয়েছেন, বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, অধ্যাপক অজয় রায়, বিচারপতি শামসুল হুদা, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, কর্নেল (অব) আবু ওসমান চৌধুরী, লেখক সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, সাংবাদিক কামাল লোহানী, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক অনুপম সেন, কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, শিল্পী হাশেম খান, শিল্পী রফিকুননবী, অধ্যাপিকা পান্না কায়সার, স্থপতি রবিউল হুসাইন, অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম, ক্যাপ্টেন (অব) আলমগীর সাত্তার বীরপ্রতীক, ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন বীরউত্তম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বীরউত্তম, গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব) শামসুল আলম বীরউত্তম, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুর রশীদ (অব), ডাঃ আমজাদ হোসেন, সমাজকর্মী নূরজাহান বোস, ড. নূরন নবী, লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শহীদজায়া সালমা হক, কলামিস্ট সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ, শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, সাংবাদিক চলচ্চিত্রনির্মাতা শামীম আখতার, অধ্যাপক আবুল বারক আলভী, সমাজকর্মী কাজী মুকুল, সমাজকর্মী খোন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ, ড. ফরিদা মজিদ, সমাজকর্মী আরমা দত্ত, এ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম, এ্যাডভোকেট খন্দকার আবদুল মান্নান, অধ্যাপক আয়েশ উদ্দিন প্রমুখ। ওয়ার্কার্স পার্টি ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে পরিকল্পিতভাবে আগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। শনিবার দলের পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তারা বলেন, ফেসবুকে কথিত পোস্ট দেয়ার নাম করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এই আল্ডমণ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরির চল্ডান্ত। নেতৃবৃন্দ বলেন, ইতোপূর্বেও কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস, ব্রাহ্মণবাড়িযার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে তান্ডব চালানোসহ বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলা চালানোর জন্য পরিকল্পিতবাবে ফেসবুক গল্প সৃষ্টি করা হয়েছে। যার সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল নেই। বিবৃতিতে তারা বলেন, অতীতেও এ ধরনের হামলার সঙ্গে যুক্ত মূল হোতাদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। তারা বলেন, কিন্তু অদৃশ্য কারণে এসব ঘটনার কোন সুরাহা হয়নি। শাহবাগে মানববন্ধন ॥ রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলার প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিকেলে লেখক-শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মীদের ব্যানারে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তারা রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মূলোৎপাটনের দাবি জানান। তারা বলেন, এই অশুভ শক্তিকে যে কোন মূল্যে পরাজিত করতে হবে। নইলে বাংলাদেশকে কোন ভাবেই এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। তাছাড়া বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো উগ্র-সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী। সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা যৌথভাবে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে।
×