ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হামলা পূর্ব পরিকল্পিত- এসপি ;###;ঘটনাস্থল পরিদর্শন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের

রংপুরে নারকীয় তাণ্ডবে জামায়াত-শিবির জড়িত

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১২ নভেম্বর ২০১৭

রংপুরে নারকীয় তাণ্ডবে জামায়াত-শিবির জড়িত

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ১১ নবেম্বর ॥ রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের শলেয়াশাহ ঠাকুরবাড়ি গ্রামে সংঘটিত শুক্রবারের সংঘর্ষের ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত। এ ঘটনায় জামায়াত জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর লক্ষ্যে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জামায়াত-শিবির এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, যে ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা বলে এই হামলা চালানো হয়েছে তা এখনও আমাদের হাতে আসেনি। আমরা সেটা পাওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের টিম নারায়ণগঞ্জে টিটুকে আটকের জন্য গেছে। তাকে পাওয়া গেলে ঘটনার রহস্য জানা যাবে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে ৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সকলেই জামায়াত শিবির কর্মী বলে তিনি দাবি করেন। নিহত হাবিবও কর্মী বলে তার দাবি। শনিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে প্রেস ব্রিফিংকালে পুলিশ সুপার এ সব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ঘটনা কিভাবে ঘটেছে তার কিছু সূত্র আমাদের হাতে এসেছে। খুব শীঘ্রই আসল রহস্য উন্মোচিত হবে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউপির বসন্তপুরের মজিবুয়াতি মিয়ার ছেলে ও ইউপি জামায়াতের সভাপতি জয়নাল আবেদীন, ওই গ্রামের হারেছ উদ্দিনের ছেলে ও ইউপি জামায়াতের সেক্রেটারি রুহুল আমিন ও উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আব্দুল হান্নানের ছোট ভাই আব্দুল মান্নানকে গ্রেফতার করা হয়েছে । বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতারুজ্জামান প্রধান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, শুক্রবারের সহিংসতার ঘটনায় স¤পৃক্ততার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। শনিবার বেলা ১২টায় তারা সেখানে পৌঁছায়। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও দিনাজপুরের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের নেতৃত্বে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখছেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন। খালিদ মাহমুদ বলেছেন, ‘আমরা এলাকা ঘুরে দেখছি। দলের হাইকমান্ডকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’ বিষয়টি সঠিকভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। তিনি বলেন, এ হামলার ঘটনায় স্বাধীনতাবিরোধীরা জড়িত। পূর্ব পরিকল্পনামাফিক তারা পূর্বের ন্যায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। তারা রামু এবং ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় যে ঘটনা ঘটিয়েছিল এখানেও সেই একই ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবিরসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা সর্বদাই নানা রকম দেশ বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত। ৭ বছর ধরে গ্রাম ছাড়া টিটু : স্থানীয়দের দাবি হামলা পরিকল্পিত ধর্ম নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তি ও অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার ঘটনায় অভিযুক্ত টিটু রায় গত সাত বছর ধরে গ্রামছাড়া। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে এবং এনজিও থেকে কয়েক লক্ষাধিক টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পেরে নিজ বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান টিটু। এছাড়াও দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে বিধবা মা ও ছোট ভাই বিপুলের সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগও করেন না টিটু। শনিবার দুপুরে টিটুর মা জীতেন বালা, ছোট ভাই বিপুলসহ স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এছাড়া শুক্রবারের হামলার ঘটনা পরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। শুক্রবার জুমা নামাজের পর রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের শলেয়াশাহ ঠাকুরবাড়ি গ্রামে স্থানীয় মুসল্লি ও গ্রামবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় ৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং ভাংচুরসহ লুটপাট করা হয়। শনিবার সকালে পাগলাপীর, শলেয়া শাহ, ঠাকুরবাড়িসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশের অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ঘটনাস্থলের আশপাশের ৪-৫ গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। ওইসব এলাকায় থমথমে ও ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের। রাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনকে পুলিশ পাহারায় ঠাকুরবাড়ি প্রাইমারী স্কুলে রাখা হয়েছিল। সেখানে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়াও সকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ তিন হাজার টাকা ও দুই বান্ডিল করে টিন প্রদান করা হয়েছে। সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। টিটুর ছোট ভাই বিপুল জানান, দুই ভাই মিলে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে কয়েকদিন গিয়েছিলেন। একদিন এক শিক্ষক টিটুকে মারধর করায় সেদিন থেকে সে স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়। টিটু নিজের নামটাও লিখতে পারে না বলে দাবি করেন বিপুল। এদিকে বিপুলের মা জীতেন বালারও দাবি, টিটু হাতেগোনা কয়েকদিন স্কুলে গিয়েছিল। ফেসবুক কী তা নিজে না জানলেও তার ছেলে এটা ব্যবহার করতে পারবে না বলে মনে করেন তিনি। জীতেন বালা আরও জানান, প্রথম বিয়ে করার পর স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামেই ছিল টিটু। সাত বছর আগে ্ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় স্ত্রীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ চলে যান। সেখানে গিয়ে আরও একটি বিয়ে করেছেন বলে তিনি শুনেছেন। এ নিয়ে প্রথম স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। টিটু সেখানে কি কাজ করেন তাও সঠিকভাবে জানেন না এবং সাত বছর ধরে তার কোন খবর নেন না বলে জানান জীতেন বালা। টিটুর বাড়িসংলগ্ন গুদামঘর ভাড়া নিয়ে তামাকের ব্যবসা করছেন রতন রায়। ঘটনার দিন তার গুদাম ঘরও ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। তিনি এ ঘটনাকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে ওই এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছিল একটি মহল। শুক্রবার পূর্ব নির্ধারিত বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচী ঘিরে পুলিশ মোতায়েন ছিল। কর্মসূচী শেষ করার পর অতর্কিতভাবে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক ও ধানক্ষেত দিয়ে হাজার হাজার লোক ঠাকুরবাড়ি গ্রামের দিকে আসতে থাকে। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ ঘটনার ইন্ধনদাতা কারা? এ বিষয়ে জানতে চাইলে রতন তাদের চিনেন না বলে জানান। তবে এ হামলার সঙ্গে বহিরাগত লোকজন জড়িত বলে তিনি মনে করছেন। টিটুর প্রতিবেশী নিবারণ রায় গত ৬/৭ বছর ধরে টিটুকে গ্রামে দেখেননি বলে দাবি করে বলেন, সে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আর আসেনি। তিনিও এ ঘটনাকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে দাবি করেন। এদিকে টিটুর ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খুঁজে দেখা যায়, এমডি টিটু নামে টিটু রায়ের ছবি দিয়ে ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খুলে গত ১৯ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি ও অবমাননাকর ছবিসম্বলিত একটি পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে টিটুর ছোট ভাই বিপুলের কাছ থেকে পাওয়া টিটুর মুঠোফোন (০১৭৫৫৪৪১৯৫৬) নম্বরে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এদিকে শনিবার বেলা ১২টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর একটি মহল দেশকে নানাভাবে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। আগামী নির্বাচন ঘিরে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য তারা বিভিন্নভাবে পরিকল্পনা করছে। এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া সরকারীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সব ধরনের সহযোগিতা করার কথাও বলেন তিনি। এ সময় দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুজ্জামান, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নাসিমা জামান ববি, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান শনিবার পুনরায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতার কথা জানান। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া এলাকার মৃত খগেন রায়ের ছেলে টিটু রায়ের ফেসবুকে স্ট্যাটাস ঘিরে গত কয়েক দিন ধরে ওই গ্রাম ও আশপাশ এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এ ঘটনায় গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের লালচান্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে টিটু রায়কে আসামি করে ৫ নবেম্বর গঙ্গাচড়া থানায় মামলা করেন। স্থানীয় রফিকুল ইসলাম জানান, ওই যুবককে গ্রেফতারের দাবিতে গত মঙ্গলবার পাগলাপীর এলাকায় বিক্ষোভ হয়। ওই দিন বিক্ষোভ সমাবেশে কয়েক শ’ মানুষ ছিলেন। বিক্ষোভের পর তাকে (টিটু) গ্রেফতারের দাবিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। পরে পুলিশ সুপারের কাছে গিয়ে তাকে গ্রেফতারের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়। এরপরেও সে গ্রেফতার না হওয়ায় এরই প্রতিবাদে শুক্রবার জুমার নামাজের পর স্থানীয় মুসল্লিরা একজোট হয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচী শুরু করেন। এ সময় ওই কর্মসূচীতে সংহতি জানিয়ে আশেপাশের কয়েক হাজার মুসল্লি যোগ দেন। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ মুসল্লি ও গ্রামবাসী ঠাকুরপাড়ার ৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বেশ কয়েকটি গাড়িতে ভাংচুর চালায়। এ সময় পুলিশ বাঁধা দিলে মুসল্লিদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে হাবিব (২৭) নামে এক স্থানীয় যুবক নিহত ও পুলিশসহ অন্তত ১৫জন আহত হয়েছেন। হাবিব ওই এলাকার একরামুল হকের ছেলে। আহতদের মধ্যে ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহতদের রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে, রংপুরে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তি ও অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগে সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় থানায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত দুই হাজার জনকে আসামি করে পৃথক দুটি মামলা করেছে পুলিশ।
×