ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

নতুন যুগে আমাদের সোনালি আঁশ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১২ নভেম্বর ২০১৭

নতুন যুগে আমাদের সোনালি আঁশ

বাংলাদেশ ‘সোনালি আঁশের দেশ’। পাট আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল। বাঙালীর জীবন-জীবিকা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে পাট চাষ। অবিভক্ত বাংলায় পাটের বর্ণময়, উজ্জ্বল ও সোনালি অধ্যায় শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে এবং এ অঞ্চলে শিল্প যুগের সূচনা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে পাটকল স্থাপনের মধ্য দিয়ে। উর্বর গাঙ্গেয় উপত্যকা, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার কারণে বঙ্গীয় অঞ্চল পাট চাষের জন্য বিশ্বে সবচেয়ে উপযোগী জায়গা। পাট ‘সোনালি আঁশের’ মর্যাদা অর্জন করেছিল ১৮৯০-এর দশকে। গত শতাব্দীজুড়ে আন্তর্জাতিক নীতি, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক মন্দা, ‘সিনথেটিক বিপ্লব’সহ বিভিন্ন কারণে পাটের গৌরব ওঠানামা করেছে। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় বাংলার পাট আবার নতুন সম্ভাবনার মুখ দেখছে। গ্রিন ইকোনমি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ন্যাচারাল ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা ও সরকারের সাহসী পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের ‘ সোনালি সম্ভাবনা’ দেখা দিয়েছে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্য ছিল বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য। কিন্তু কৃত্রিম আঁশ আবিষ্কারের ফলে পাটের সেই রমরমা দিন একটা পর্যায়ে নিষ্পেষিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টি হওয়াতে পাটের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল পাটের সম্ভাবনাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। লিকলিকে লম্বা পাটগাছ বাতাসে নুয়ে পড়ে, কিন্তু ভাঙ্গে না। কারণ, এতে লিগনিন নামে এক ধরনের জৈব রাসায়নিক বেশি থাকে। তুলায় লিগনিন থাকে না বলে তা নরম ও তুলতুলে। কাপড় তৈরির বাজারে পাটের আঁশের চেয়ে তুলার সুতার দাম ও কদর বেশি। পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের পর এখন নতুন নতুন উদ্ভাবন সম্ভব হচ্ছে। সম্প্রতি পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাটের লিগনিনের জন্য দায়ী জিনকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে পাটের উৎপাদন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। পাট ও ছত্রাকের ৭টি জিনের পেটেন পেয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে বিশ্বের যে কোন জায়গায় নতুন জাতের পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে অর্থ দিতে হবে। এর মধ্য দিয়ে পাটের নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। এ ছাড়া যেকোন উদ্ভিদ বা ফল থেকে যাতে দ্রুত রস, জৈব জ্বালানি ও প্রসাধনী তৈরি করা যায়, সেই কাজেও সাফল্য পেয়েছেন ওই বিজ্ঞানী দল। এ জন্য তারা এক ধরনের ছত্রাকের তিনটি জিন শনাক্ত করে সেগুলোর পেটেন্ট পেয়েছেন। বিশ্ব কৃতিস্বত্ব কর্তৃপক্ষের (ডব্লিউআইপিও) কাছ থেকে পাট ও ছত্রাকের এই সাতটি জিনের কৃতিস্বত্ব পাওয়ার একটি অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। তা হচ্ছে বিশ্বের কোথাও এ নিয়ে কোন বাণিজ্যিক গবেষণা হলে বাংলাদেশের অনুমতি নিতে হবে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী এই উদ্ভাবন থেকে কোন আয় হলে তার একটি অংশ বা রয়্যালটি বাংলাদেশকে দিতে হবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও হংকং এবং ইউরোপের ২৮টি দেশ এই পেটেন্টকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ব্রাজিল এখনও তা দেয়নি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত এখন গার্মেন্টস শিল্প। কিন্তু এই শিল্পের বাজার প্রতিযোগিতা পূর্ণ। যদি গার্মেন্টসের পাশাপাশি পাট দাঁড়াতে পারে সেটা বেশি ভাল হয়, কারণ তাতে মূল্য সংযোজন হবে বেশি। গার্মেন্টস এ যেমন টাকা আসে তেমনি এর কাঁচামালে তার একটা বড় অংশ ব্যয়ও হয়ে যায়। কিন্তু পাটের ক্ষেত্রে তেমনটা হবে না। সবচে’ বড় কথা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে একাধিক বড় খাত থাকলে তা টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হবে। পাটের আঁশের মধ্যে সাধারণত ১২ থেকে ১৪ শতাংশ লিগনিন থাকে। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, প্রাথমিকভাবে লিগনিনের পরিমাণ কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে। এতে আঁশ নরম হবে। ফলে পাট দিয়ে শার্ট, প্যান্ট বা সমজাতীয় পোশাক প্রস্তুতের সুতা তৈরি করা যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের বিজ্ঞানীরা পাটের সুতা ও তুলার সুতা মিশিয়ে কাপড় তৈরি করছেন। সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন পোশাক প্রস্তুত হলেও তা বেশ শক্ত হওয়ায় খুব বেশি বাজার পাচ্ছে না। এমন সুতা মূলত দরজা-জানালায় ব্যবহৃত পর্দা, কার্পেট ও তৈজসপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পাটের তৈরি জিনসের প্যান্ট ও অন্য পোশাক তৈরি করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি করলেও মূলত এর কাপড় প্রয়োজনীয় মাত্রায় নরম করতে না পারায় বাজার বড় হচ্ছে না।
×