ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

উপকূলে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১২ নভেম্বর ২০১৭

উপকূলে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল কেন্দ্র করে পর্যটন ব্যবসার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পশ্চিম প্রান্তের সুন্দরবন থেকে শুরু করে পূর্বের টেকনাফ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। যার প্রতিটি স্থান কেন্দ্র করে বছরে লেনদেন হতে পারে কম করে হলেও কয়েক হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থান হতে পারে অসংখ্য মানুষের। গড়ে উঠতে পারে সরকারী-বেসরকারী হাজারও স্থাপনা। বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে বিপুল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অনেকটা অবহেলিত রয়ে যাচ্ছে উপকূলের পর্যটন শিল্প খাতটি। পৃথিবীর জীবন্ত বদ্বীপগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রকৃতিগতভাবেই এর ভৌগোলিক অবস্থান পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়। শুধু দেশীয় নয়, বিদেশীদের কাছেও এর আকর্ষণ প্রবল। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, সাগরের নীল জলরাশি, পাহাড়ের গিরিশৃংঙ্ঘ, সবুজ অরণ্য, জেলেদের জীবন-জীবিকা, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন। সবই পর্যটকদের সমানভাবে টানে। উপকূলের পূর্ব-পশ্চিম দৈর্ঘ্যরে আয়তন ৭১০ কিলোমিটার। এর প্রতিটি বাঁকে রয়েছে প্রকৃতির অপার বিষ্ময়। পশ্চিমে সাতক্ষীরা জেলার কালিঞ্চি গ্রাম থেকে শুরু বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের। যা ছড়িয়ে আছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালী জুড়ে। দু’ শ’ বছর আগে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১৬ হাজার ৭ শ’ বর্গকিলোমিটার। যা বর্তমানে কমে দশ হাজার বর্গকিলোমিটার এসে ঠেকেছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সুন্দরবনের অন্যতম সম্পদ হচ্ছে সুন্দরী গাছ। ধারণা করা হচ্ছে, সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে। সুন্দরী ছাড়াও সুন্দরবনে কেওড়া, ছৈলা, গোল, বাইন, পশুর, গেওয়া, গরান, আমুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ রয়েছে। বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে মাকড়শার জালের মতো বিছানো ৪৫০টি ছোট বড় নদী ও খালে রয়েছে ডলফিন, ইলিশ, ভেটকিসহ ২৯১ প্রজাতির মাছ, ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। সুন্দরবনের শীর্ষ সম্পদ হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। এছাড়া, রয়েছে চিত্রাহরিণ, কুমির ও বানর। রয়েছে আদিবাসী মুন্ডাদের গ্রাম। এসবই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়ায় এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশে দেশী-বিদেশী পর্যটক টানতে সেখানকার সরকার প্রচুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমাদের এখানে তার অনেক কিছুই অনুপস্থিত অথচ শুধু সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনই পাল্টে দিতে পারে আমাদের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি। বরগুনার তালতলী উপজেলার সোনাকাটা ইকোপার্ক সাম্প্রতিককালে পর্যটনকেন্দ্রের তালিকায় উঠে এলেও নেই পর্যটক টানার গতিশীল উদ্যোগ। একইভাবে পটুয়াখালীর সর্বশেষ দক্ষিণ প্রান্তে সাগর ফুড়ে জেগে ওঠা প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি ‘সোনারচর’ নিয়েও নেই তেমন কার্যক্রম। পাঁচ হাজার একরেরও বেশি আয়তনের বনাঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠা সোনারচরকে কয়েক বছর আগে বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সোনারচরে রয়েছে দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত। সোনারচরে একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। এত বিশাল ও বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও সোনারচরে পর্যটকদের আসা-যাওয়া প্রায় নেই বললেই চলে। একই ভাবে অবহেলিত পড়ে আছে গভীর সমুদ্রের দ্বীপ চরহেয়ার বা চর জাহাজমারা। ১৯৯৮ সালে পটুয়াখালীর অন্যতম দর্শনীয় স্থান কুয়াকাটাকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে সেখানে গড়ে উঠেছে সরকারী-বেসরকারী অসংখ্য স্থাপনা। বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। যোগাযোগ ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে সড়ক পথে কুয়াকাটা যেতে নদী পার হতে আর ফেরির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি সেতু। প্রশাসনিক ভাবেও কুয়াকাটা অনেক পাল্টে গেছে। ইউনিয়ন থেকে কুয়াকাটাকে পৌরসভায় উন্নীত করা হয়েছে। স্থাপন হয়েছে থানা। রয়েছে চমৎকার আবাসিক ব্যবস্থা। প্রকৃতিকে নীরবে-নিভৃতে উপভোগ ছাড়াও এখানকার আদিবাসী রাখাইনদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনধারা ও বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা পর্যটকদের নিঃসন্দেহে বিমোহিত করে। এছাড়া, পায়রা সমুদ্রবন্দর কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও বছরের একটা সময়ে বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কুয়াকাটা পর্যটক শূন্য হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা লোকসান গোনে। ভোলার চরকুকরিতেও পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ভোলার হাতিয়া ও নোয়াখালীর নিঝুমদ্বীপসহ আশপাশে অসংখ্য ছোটবড় দ্বীপ রয়েছে, যার প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত রয়েছে কক্সবাজারে। এর খানিক দূরেই রয়েছে ইনানী বা হিমছড়ি সী বিচ। যেখানে পাহাড় এবং সমুদ্র মিশেছে হাত ধরাধরি করে। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে প্রাচীন আমলের দীর্ঘ গুহা। মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপও পর্যটকদের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয়। চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থান পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। কর্ণফুলী নদী মোহনার এ সমুদ সৈকত পর্যটকদের কাছে যথেষ্ট মোহনীয়। একইভাবে পারকি সমুদ্র সৈকতও ধীরে ধীরে পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন অসংখ্য পর্যটকের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় সেন্টমার্টিনের অবস্থান। আর এ অবস্থানই সেন্টমার্টিনকে দিয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ছাড়াও কক্সবাজারে রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বাস। রামুতে রয়েছে প্রাচীন আমলের দর্শনীয় বৌদ্ধ মন্দির। রয়েছে দুর্লভ বেশ কিছু মূর্তি। বাংলাদেশের দীর্ঘ উপকূলের ভাঁজে ভাঁজে এমন অসংখ্য দর্শণীয় স্থান রয়েছে, যা পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। যা ২০২০ সালে ১৬০ কোটিতে দাঁড়াবে। আর এ বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এছাড়া, ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্পে ২৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। যা বিশ্ব অর্থনীতিতে ১০ দশমিক ৫ ভাগ অবদান রাখবে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি) ২০১৪ সালে এক প্রতিবেদনে বিশ্বের যে ২০টি দেশ পর্যটন খাতে ভাল প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে, তার অন্যতম বাংলাদেশ বলে উল্লেখ করেছিল। বাংলাদেশ সরকারও এ খাতটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৬ সাল সরকারীভাবে বাংলাদেশে পর্যটন বর্ষ হিসেবে পালিত হয়েছে। এ বছরের ৭ জুন পটুয়াখালী-৩ আসনের এমপি আখম জাহাঙ্গীর হোসাইনের প্রশ্নের উত্তরে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে জানান, গত ৮ বছরে পর্যটন খাতে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা আয় হয়েছে। এরমধ্যে ২০১৬ সালে ৮০৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে এক হাজার ১৩৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে এক হাজার ২২৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ৯৪৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, ২০১২ সালে ৮২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১১ সালে ৬২০ কোটি ১৬ লাখ টাকা, ২০১০ সালে ৫৫৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ২০০৯ সালে ৫৭৬ কোটি ২২ লাখ টাকা আয় হয়েছে। মন্ত্রী সংসদে আরও জানান, ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীতকরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে ডব্লিউটিটিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর এ খাতে ২ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসেবে ২০২৪ সালে পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থানের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ডব্লিউটিটিসি অপর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৫ সালে বিনিয়োগ হয়েছে ৬ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। যা দেশের মোট বিনিয়োগের ১ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৬ সালে এখাতে বিনিয়োগ দাঁড়াবে ১৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে দর্শনীয় বস্তু ও স্থানের অভাব নেই। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থান উপকূলকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। সাগর ও প্রকৃতিকে উপভোগ করে না, পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার জন্য কক্সবাজার ও সুন্দরবনের মতো বৃহত্তর স্থান ছাড়াও ছোট ছোট অসংখ্য মনোরম প্রাকৃতিক পয়েন্ট রয়েছে, যেগুলোতে সামান্য একটু উদ্যোগ-আয়োজন নেয়া হলেই পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়বে। যথেষ্ট সম্ভাবনা সত্ত্বেও উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম হচ্ছে-সহজ ও সাবলীল যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। এরপরেই রয়েছে নিরাপত্তার ঘাটতি। রয়েছে আবাসিক সমস্যা ও মাত্রাতিরিক্ত অর্থ খরচের বিষয়। নেই পর্যটনবান্ধব পরিবেশ। প্রচার-প্রচারণার অভাবও রয়েছে ব্যাপক। এমন আরও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে, যা দূর করা গেলে অন্য সম্পদের মতো পর্যটনও হতে পারে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সত্যিকার অর্থে আরেকটি শিল্প।
×