ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হেমন্তে ফুটেছে ফুলও

স্পর্শকাতর তরু,লজ্জাই ভূষণ লজ্জাবতীর

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১২ নভেম্বর ২০১৭

স্পর্শকাতর তরু,লজ্জাই ভূষণ লজ্জাবতীর

মোরসালিন মিজান গাছেরও প্রাণ আছে। জগদীশ বাবু জানিয়েছিলেন। আর লজ্জা? গাছের লজ্জা আছে কোন? গবেষণার প্রয়োজন নেই। ছেলে-ছোকরাটিও বলে দেবে, আছে। চটজলদি এই উত্তর অন্য কোন গাছের দিকে তাকিয়ে নয়, লজ্জাবতীর কথা ভেবে। গাছটির অদ্ভুত স্বভাবের কথা জানা আছে সবার। নতুন বউয়ের মতো লাজুক। লাজুক লতা। কবিগুরু লিখেছিলেনÑ নাই কি রে তীর, নাই কি রে তোর তরী?/কেবলি কি ঢেউ আছে তোর?/হায় রে লাজে মরি...। এই লাজের পুরোটাই যেন নিজের মধ্যে ধারণ করেছে লজ্জাবতী। সামান্য ছুঁয়ে দিলেই হলো, গুটিয়ে নেয় নিজেকে। খুব লজ্জা বলেই যে গাছটির লজ্জাবতী নাম, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইংরেজী নামটি মিমোশা। বাংলার চোখে দেখলে মিমোশা তো মেয়েদেরই নাম। মেয়েরা যেমন অপেক্ষাকৃত লাজুক হয়, লজ্জাবতী ঠিক তা-ই। এই নবেম্বরে পাতা খেলার সঙ্গে যোগ হয়েছে ফুলের সৌন্দর্য। লজ্জাবতী মানুষের স্পর্শ নয় শুধু, যে কোন ধরনের স্পর্শে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পাতা যৌগিক। দুই সারি পত্রক বিদ্যমান। সামান্য স্পর্শ পেলে একটি আরেকটির গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যায়। মৃত লতা পাতার মতো মাটির ওপর শুয়ে পড়ে। নিস্তেজ হয়ে যায়। তাপের প্রভাবে এবং সন্ধ্যার পর আপনি গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী। এত যে লজ্জা, কেন? রহস্যাটা কী আসলে? জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, লজ্জাবতী গাছের পাতার গোড়ার অংশের কোষগুলো পানিতে পূর্ণ থাকে। এ কারণে সেগুলো বেশ ফোলা দেখায়। কিন্তু ডাটাগুলো হয় সরল ও সোজা। আঙুল দিয়ে পাতা সামান্য ছুঁয়ে দিলে গাছের পুরো শরীরে মৃদু তড়িত প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে পাতার গোড়ার ফোলা অংশ থেকে পানি বেরিয়ে বোঁটার দিকে নেমে যায়। আর পাতার কোষগুলোর জলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে তা কুঁচকে আসে। নুয়ে পড়ে। তাপের প্রভাবে ও সন্ধ্যার পর আপনি নিজেকে গুটিয়ে নেয় লজ্জাবতী। গবেষণা বলছে, লজ্জাবতী প্রায় ৪শ’ প্রজাতির গুল্ম ও লতার একটি গণ (জেনাস)। এটি লেগিউম জাতীয় ফ্যাবায়েসি পরিবারের এবং মিমোসয়ডিয়া উপ-পরিবারের সদস্য উদ্ভিদ। লজ্জাবতীর সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতিটির নাম মিমোসা পুডিয়া। আদি নিবাস মধ্য আমেরিকা। বাংলাদেশেরও খুব পরিচিত লতা। প্রায় সকল লজ্জাবতীর কা- সরু কাঠির মতো। অনেক শাখা প্রশাখা। এই নবেম্বরে সুন্দর ফুলও ফুটে আছে। জঙ্গলে ফুটে থাকা গোলাপি এবং সাদা রঙের ফুলের সৌন্দর্য দারুণ উপভোগ্য। লজ্জায় ডুবে থাকা গাছের প্রাণ বড় শক্ত। আগাছার মতো হওয়ায় অনেকে একে পায়ে মাড়িয়ে যান। কিন্তু গাছটি সহজে মরে না। বরং নিশ্চিহ্ন অবস্থা থেকেও যৌবনে প্রবেশ করতে জানে। একইভাবে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে এটি জন্মাতে পারে। কোন রোগ বা পোকা একে কাবু করতে পারে না। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার গবেষণা থকে জানা যায়, দেশে লজ্জাবতীর দুটি জাত রয়েছে। একটি দেশীয়। অন্যটি থাই লজ্জাবতী। দেশীয় লজ্জাবতীর বৃদ্ধি কম। এটি ৩ থেকে ৭ ফুট লম্বা হয়। গায়ে সূক্ষ্ম কাঁটার অস্তিত্ব দেখা যায়। অন্যদিকে থাই লজ্জাবতী গাছে কোন কাঁটা হয় না। এটি দ্রুত বাড়ে। গাছ প্রায় ৩ থেকে ১০ ফুট লম্বা হয়। গাছ নরম ও রসালো বলে দ্রুত পঁচে যায়। ফলে এ জাতীয় লজ্জাবতী থেকে প্রচুর জৈব সার পাওয়া যায়। এই জৈবসার থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে অন্য গাছ। থাই লজ্জাবতীতে ২.০৩ থেকে ২.৬ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.১৭৫ থেকে ০.২৩ ভাগ ফসফরাস এবং ১.২৩৭ থেকে ১.৭৪১ ভাগ পর্যন্ত পটাশিয়াম থাকে। এসব কারণে জমিতে জৈব সারের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ভাবা হয় থাই লজ্জাবতীকে। বাংলাদেশেও লজ্জাবতী থেকে জৈব সার তৈরি ও ব্যবহারের কাজ শুরু হয়েছে। তবে একসময় বাংলাদেশের আনাচে কানাচে যে গাছটি দেখা যেত এখন সেটি যারপরনাই দুর্লভ। ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের এই গাছের সংখ্যা কমছে কেবল। এ অবস্থায় ছুঁয়ে দেয়ার নামে ডাল পালা ভেঙ্গে দেয়া নয়, পায়ে মারিয়ে যাওয়া নয়, একটু যত্ন ও চাই লজ্জাবতীর।
×