ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাড়ছে দুর্ঘটনা, নিষ্ক্রিয় প্রশাসন

মহাসড়ক থেকে নগরপথে নিয়ন্ত্রণহীন অবৈধ ভটভটির দৌরাত্ম্য

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১১ নভেম্বর ২০১৭

মহাসড়ক থেকে নগরপথে নিয়ন্ত্রণহীন অবৈধ ভটভটির দৌরাত্ম্য

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহী নগরীতে এমনিতেই অটোবাইক, ব্যাটারিচালিত রিক্সায় আধিক্য; তারপর যোগ হয়েছে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত অবৈধ যানবাহন ভটভটি। শুধু শহর নয়, এসব অবৈধ যানবাহন এখন রাজশাহীর মহাসড়কগুলোয় দাপিয়ে ফিরছে। নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে দাপিয়ে বেড়ানো এসব যানবাহন শহরের প্রধান সড়ক ছাড়াও চলছে অলিগলি পথে। ফলে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। প্রশাসনের নিষ্কিয়তায় মহাসড়কে দৌরাত্ম্য বাড়ছে এসব যানবাহনের। প্রশাসন বলছে, কঠোর অভিযানেও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ যানগুলো। আর ভটভটিচালকদের ভাষ্য, সড়কে পুলিশকে চাঁদা দিয়ে চলছেন তারা। শহরের পথ কিংবা মহাসড়কে থ্রি হুইলার অটোরিক্সা, অটো টেম্পো ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও এসব যানবাহনের কাছে অসহায় খোদ প্রশাসন। সড়ক নিরাপত্তায় ২০১৫ সালে মহাসড়কে যান চলাচলে এ বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও তা না মেনেই চলছে অবৈধ যানবাহন। ক্রমেই বাড়ছে এসব ভটভটির সংখ্যাও। জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পশুর হাট সিটি হাট বসে সপ্তাহের প্রতি রবি ও বুধবার। এ দুই দিন রাজশাহী নগরীর প্রবেশপথ নওদাপাড়া আমচত্বরে লেগে থাকে দীর্ঘ যানজট। আর এজন্য দায়ী পশু বহনকারী ভটভটিগুলো। তা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। এসব যানবাহন মহনগরীর মধ্যেই যত্রযত্র প্রবেশ করে প্রতিনিয়ত। শহর ও বিভিন্ন মহাসড়কে যেসব ট্রাফিক পুলিশ এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে গলদঘর্ম, তাদের বিরুদ্ধেই রয়েছে ভটভটি থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ। রাজশাহী নগরী ও আশপাশের অন্তত ১০টি পয়েন্টে আদায় হচ্ছে এ চাঁদা। দিনে গড়ে আদায় পাঁচ লাখ টাকা করে। এ কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব অবৈধ যানবাহন চলাচল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর আমচত্বরে প্রকাশ্যেই চাঁদা আদায় হয় অবৈধ যানবাহন থেকে। এছাড়াও রাজশাহী বাইপাস মহাসড়কের তালাইমারী ও কাশিয়াডাঙ্গাতেও চাঁদা উঠছে প্রকাশ্যে। চাঁদা আদায় হচ্ছে আন্তঃজেলা ও জেলা সড়কগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে। এর মধ্যে নগরীর উপকণ্ঠ নওহাটা, দুর্গাপুর পৌরসভা বাজার এলাকা, চারঘাট-বাঘা, গোদাগাড়ী, তানোর, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাগমারাতেও ভটভটি থেকে চাঁদা আদায় হচ্ছে প্রতিদিন। আর নওহাটা ও দুর্গাপুরে পৌরসভার রসিদে চলছে চাঁদা আদায়। সরেজমিন বেশ কয়েকটি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, ভটভটি সামনে পেলেই দৌড়ে গিয়ে থামাচ্ছেন আদায়কারীরা। নাম প্রকাশ না করে আদায়কারীদের কয়েকজন জানান, পুলিশের হয়ে চাঁদা আদা করছেন তারা। এ চাঁদা দিয়ে মহাসড়কে এসব যান চলাচলের বৈধতা মেলে ট্রাফিক পুলিশের। চাঁদা তুলে দেয়ার জন্য তারাও ভাগ পান। ভটভটিচালকদের ভাষ্য, পশুবাহী ভটভটি থেকে বিপুল পরিমাণ চাঁদা আদায় হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত ২০ টাকা করে দিতে হয় তাদের। চাঁদা পরিশোধের পর তাদের রসিদ ধরিয়ে দেয়া হয়। ওই রসিদ দেখলে ছেড়ে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। হয়রানি এড়াতে বাধ্য হয়ে চাঁদা দিচ্ছেন চালকরা। তবে অবৈধ যান থেকে পুলিশের চাঁদা আদায়ের খবর তাদের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখায়ের আলম। এমন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঁইয়া। তবে এটি স্থানীয় কিছু লোক এর সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেন পুলিশ সুপার। মহাসড়কে অবৈধ এ যান বন্ধে তাদের করণীয় নেই বলে দাবি করেছেন রাজশাহী বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিন) এসএম কামরুল হাসান। তিনি বলেন, এসব যান রুট পারমিটবিহীন। ফলে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দুরূহ। তারপরও বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে তারা যৌথ অভিযান চালান। এসব অভিযানে মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুর্ঘটনা রোধসহ সড়কপথের শৃঙ্খলা ফেরাতে অবৈধ এ যান চলাচল বন্ধ করা জরুরী বলে জানিয়েছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগে ২০১৪ সালের মাঝামাঝিতে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন মহাসড়কে ভটভটি বন্ধে বিশেষ অভিযান চালায় প্রশাসন। ওই সময় বিপুলসংখ্যক ভটভটি অকেজোসহ চালককে দ- দেয়া হয়। সিলগালা করে দেয়া হয় বেশকিছু ভটভটি তৈরির কারখানা। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা ভটভটিচালককের পক্ষ নেন। এরপর ধীরে ধীরে কমে আসে অভিযান। এখন মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ালেও অবৈধ এ যান বন্ধে তেমন অভিযান নেই। রাজশাহীর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) আমিনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই তারা মহাসড়কে অবৈধ যান বন্ধে অভিযান চালিয়ে আসছেন। তবে সম্প্রতি এ অভিযানে ভাটা পড়েছে। মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ে আবারও অভিযান জোরদার করা হবে। চাহিদা থাকায় এ যানের বহর বাড়ছে বলেও জানান তিনি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করছে প্রায় ৭০ হাজার অযান্ত্রিক যানবাহন। এর বাইরে রাজশাহী বিআরটিএর অন্তর্ভুক্ত ৫৭৬ মিনিবাস, ৩৫০ বাস, ৪১০ মাইক্রোবাস, ৯৪৯ প্রাইভেটকার, ২৯৪ জীপ, এক হাজার ১১৯ ট্রাক, ১৩১ মিনিট্রাক, ২১৯ পিকআপ, ২৯৬ হিউম্যান হলার এবং ৮০ হাজার মোটরসাইকেল চলাচল করছে সড়কে। রাজশাহী বিআরটিএ’র হিসাবে, গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত এ অঞ্চলে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০৪টি। এতে মারা গেছেন ২৫০ জন আর আহত হয়েছেন ৩৯৫ জন। দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ মহাসড়কে অবৈধ যান। সড়ক সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে বিআরটিএ। রুট পারমিট, চালকদের লাইসেন্স প্রদানসহ দেশীয় প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত এসব যানবাহনের উন্নতিতে জাতীয় নীতি প্রনয়ণের দাবি জানিয়ে আসছেন ভটভটিচালক ও মালিকপক্ষ।
×