ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

পানি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১০ নভেম্বর ২০১৭

পানি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে পানি ব্যবস্থাপনার ওপর। দেশ যখন ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে, তখন এ উন্নয়ন সামনে নিয়ে যেতে পানি সঙ্কটের সমাধান জরুরী হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এ সমস্যা সমাধানে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন জরুরী বলে মনে করছেন তারা। বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, পানি ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত শতবর্ষব্যাপী ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের সামর্থ্য বাংলাদেশের রয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ (ডেল্টা) অঞ্চল বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রায় নদ-নদীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ফলে পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের পাশাপাশি জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলার শতবর্ষব্যাপী পরিকল্পনার নাম হলো ডেল্টা প্ল্যান ২১০০। বিশেষজ্ঞদের মতে, জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি মৌসুমে দেশের ব্যাপক অঞ্চল প্লাবিত হয়। এ পানির ৯২ ভাগ আসে ভারত, চীনসহ উজানের দেশ থেকে। বাকিটা এ দেশের বৃষ্টিপাতের যোগফল। আবার গ্রীষ্মকালে দেখা দেয় খরা। সঠিক নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং বন্যা, খরা ও আরও নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ বারবার ক্ষতির শিকার হয়। এর সঙ্গে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ক্ষতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তাই ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ সমস্যা বহুলাংশে কাটাতে পারে। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে বৃহস্পতিবার রাজধানীতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজন করে ‘বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান-২১০০’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের। অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জামিলুর রেজা চোধুরী বলেন, বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৮০ ভাগ পানি নষ্ট হয় পানি অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণে। সেটা ধরে রাখতে হবে। এ পানি ধরে রাখতে তথা বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ডেল্টা প্ল্যান ভাল ভূমিকা রাখবে। এটা বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক বাধা আসবে, সেটা মোকাবেলা করেই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা করার জন্য যে জনবল লাগবে সেটা এখন থেকেই প্রস্তুত রাখতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ ও প্লাবন ভূমি, যেখানে বেশিরভাগ অর্থনীতি অভ্যন্তরীণ নদী ও সমুদ্র শাসনে প্রভাবিত হয়। প্রতি বছরের বন্যায় এ নদীগুলো আমাদের বিস্তর ভূমিকে উর্বর করে, যা আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে বেশ ভালভাবে ভূমিকা রাখছে। তাদের মতে, এর পাশাপাশি প্রতি বছর বাংলাদেশকে তার দুর্বল পানি ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোর দিক থেকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আরও অনেক ইস্যু মানুষের জীবন-জীবিকাকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে। জলবায়ু পরিবর্তন এ সময়ে খুবই একটি আলোচিত বিষয়, যার প্রভাবের ফলাফল আমরা এখন তিক্ততা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভোগ করছি। আর এ কারণেই বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা। এর একটি উল্লেখযোগ্য পটভূমি হচ্ছে সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও আমাদের টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা। আমরা যদি জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে চাই, তাহলে বাংলাদেশের ডেল্টা প্ল্যানের উদ্যোগকে এখন থেকেই সফলভাবে পরিচালিত করতে হবে। তারা বলছেন, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমাদের ডেল্টা প্ল্যানকে আরও সুপরিকল্পিতভাবে সমন্বিত করা প্রয়োজন। এখনকার ডেল্টা পরিকল্পনায় প্রধানত নদী শাসন ও খাদ্য নিরাপত্তাকেই বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবসম্মত টেকসই উন্নয়নের মূলনীতি বিশ্লেষণ করলে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও এ প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে। তবে এ প্রকল্পের একটি ভাল দিক হলো, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান সরকারী এবং বেসরকারী অনেক সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে নজর দিতে হবে, উদ্দেশ্য যেন সবার সমান হয়। সম্ভাব্য সব সাধারণ সুবিধাভোগীকে এ প্রকল্পের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো টেকসই উন্নয়নের একটি অন্যতম ধারাবাহিকতা। কিন্তু কেবল নদী খনন আর বন্দর উন্নয়ন করলে এ ডেল্টা প্ল্যানের মূল কাজে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। আমাদের আরও সমন্বয় করতে হবে। ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে পানি ব্যবস্থাপনার ওপর। দেশ যখন ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে, তখন এ উন্নয়ন সামনে নিয়ে যেতে পানি সঙ্কটের সমাধান জরুরী হয়ে পড়েছে। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ক্ষতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। এ প্ল্যান নিয়ে আমাদের সচেতনতা আরও বাড়ানো দরকার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেল্টা বাংলাদেশ, যার সঙ্গে বিশ্বের কারও তুলনা চলে না। বন্যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবার গ্রীষ্মে দেখা দেয় খরা। উভয়মুখী এ সঙ্কটে বাংলাদেশের মানুষ অপরিমেয় ক্ষতির শিকার হয়। এ সঙ্কট থেকে উত্তরণে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এর যাবতীয় সামর্থ্য এখন বাংলাদেশের আছে। কেউ ভাবেনি পদ্মা সেতু হবে, পারমাণবিক কেন্দ্র হবে, মেট্রোরেল হবে। কিন্তু এটি এখন দৃশ্যমান। তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি থাকে না। এটি দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ পানি সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে এ অঞ্চলের সব দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ভবিষত নির্ভর করছে পানি ব্যবস্থাপনার ওপর। কিন্তু এটি ইউরোপ-আমেরিকার প্ল্যানের কৌশলে প্রণয়ন করলে হবে না। এটি এখানকার পরিস্থিতি মেনেই করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মতো বিশ্বের কোথাও এত বড় বড় নদী নেই। দেশ যখন ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হতে যাচ্ছে, তখন এ সঙ্কট কাটানো জরুরী হয়ে পড়েছে। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ক্ষতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। এ প্ল্যান নিয়ে আমাদের সচেতনতা আরও বাড়ানো উচিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেল্টা বাংলাদেশ, যার সঙ্গে বিশ্বের কারও তুলনা চলে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ‘ডেল্টা প্ল্যান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ পরিকল্পনা। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ সমস্যা বহুলাংশে কাটিয়ে উঠতে পারবে। শতবর্ষব্যাপী এ পরিকল্পনা ৬০ বছর পর হলেও শুরু হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি এ সময় প্ল্যানটি সাধারণের বোঝার স্বার্থে বাংলায় দেয়ার প্রস্তাব করেন। গোলটেবিল আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে ক্তব্য দেন- বিআইআইএসএসের চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমদ এবং মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আবদুর রহমান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম।
×