ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পরোয়া করছেন না মালিক-শ্রমিকরা ;###;সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই পুলিশের দায়িত্ব শেষ

হাইকোর্টের নির্দেশ এক মাসেও কার্যকর হয়নি ॥ গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো চলছেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১০ নভেম্বর ২০১৭

হাইকোর্টের নির্দেশ এক মাসেও কার্যকর হয়নি ॥ গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো চলছেই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঢাকার রাস্তায় গত ২৭ আগস্টের পর কোন যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো হলে গাড়িসহ তা জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল উচ্চ আদালত থেকে। নির্ধারিত তারিখের পর কোন গাড়িতে এই হর্ন বাজানো হলে ওই গাড়িও জব্দ করতে পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) ও ডিএমপি, মহানগরীর চার বিভাগের ট্রাফিকের ডেপুটি কমিশনারসহ ঢাকার ২০ থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি পরিবহন সংশ্লিষ্টদের গত ৮ অক্টোবর মালিক-চালকদের কাছে থাকা যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন সংশ্লিষ্ট থানায় ১৫ দিনের মধ্যে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বাস্তবতা হলো, এক মাসেও উচ্চ আদালতের নির্দেশ কার্যকর হয়নি। রাজধানীর যানবাহনে ব্যবহৃত ক্ষতিকর হাইড্রোলিক হর্ন কোন থানায় জমা পড়েনি। পরিবহন মালিক বা চালক, কেউ-ই আমলে নেননি ওই আদেশ। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা না আসায় হর্ন খোলেননি তারা। মালিকরা বলছেন, খোলার নির্দেশনা দেয়ার পরও চালকরা নিজেদের সুবিধার্থে গাড়িতে এই হর্নের ব্যবহার করছে। এছাড়া ক্ষতিকর এই হর্নের উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের একাধিক নেতা জানান, সাধারণত ভারি যানবাহনে উচ্চমাত্রার হর্নের ব্যবহার বেশি। আদালতের নির্দেশের পর স্বপ্রণোদিত হয়ে হর্ন খোলার কোন নজির নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে হর্ন অপসারণের পরও নতুন করে তা আবারও লাগানোর নজির রয়েছে। পুলিশ বলছে, ক্ষতিকর হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার কমাতে অভিযান চলমান। গত এক বছরের অভিযানে ১০ হাজার উচ্চমাত্রার হর্ন জব্দ করা হয়েছে। এখন হাইড্রোলিক হর্ন না বাজাতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। বিআরটিএ বলছে, মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী উচ্চমাত্রার হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাই এই হর্নের ব্যবহার কমাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলমান। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরাও চাই না হর্নের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হোক। সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় আশা করি হাইড্রোলিক হর্ন অপসারণ করা হবে। এজন্য তিনি মালিক-শ্রমিকসহ বিআরটিএ ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন। হাইড্রোলিক হর্ন খোলার পক্ষে একমত পোষণ করে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব বলেন, আমরা কখনই চাই না পরিবেশ দূষণ করে যানবাহন চলুক। সবসময় আমরা এই হর্নের বিরুদ্ধে। কিন্তু সমস্যা হলো চালকরা তাদের চালানোর সুবিধার্থে এসব হর্ন ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশনার পরে মালিক সমিতির বৈঠক শেষে চালক ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে হর্ন খুলতে মৌখিক সাংগঠনিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরপর যদি কেউ নির্দেশ না মানে তাহলে এর দায় চালকসহ শ্রমিকদের। যদি কোন গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন পাওয়া যায় তাহলে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে আমাদের কোন আপত্তি নেই বলেও জানান এই পরিবহন নেতা। তিনি বলেন, সরকারী নির্দেশ মতো গাড়ির বাম্পার ও সাইড এঙ্গেল খোলা হয়েছে। আমাদের নির্দেশনায় শ্রমিকরা তা খুলেছে। এখন হর্ন না থাকলেও চলবে। এতে আমাদের কোন ক্ষতির কারণ নেই। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সচিব শওকত আলী বলেন, আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মোবাইল কোর্টের অভিযান চলমান আছে। প্রতিদিন আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা রাতেও বেলায়ও অভিযান চালাচ্ছি। আশাকরি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। থানায় জমা পড়েনি হর্ন ॥ ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালিকরা স্বেচ্ছায় জমা দিচ্ছেন না হাইড্রোলিক হর্ন। ট্রাফিক পুলিশকে অভিযান পরিচালনা করেই অপসারণ করতে হচ্ছে। তবে পরিবহন মালিকরা মনে করেন, হর্নটি ভেঙ্গে ফেললে বা নিজেরা খুলে ফেললে তা থানায় জমা দেয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবহন মালিকরা ঢাকার ৪৯টি থানার কোনটিতেই গিয়ে হাইড্রোলিক হর্ন জমা দেননি। ডিএমপির গাবতলী সংলগ্ন থানা দারুসসালামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ সেলিমুজ্জামান বলেন, আমাদের থানায় পরিবহন মালিকরা কেউ হাইড্রোলিক হর্ন জমা দেননি। রাজধানীর তেজগাঁও ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। এ দুটি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল সেখানেও কোন হর্ন জমা পড়েনি। মিরপুর, মোহাম্মদপুর এলাকার থানাগুলোতেও হর্ন জমা দেয়নি কেউ। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে অনেক ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে সোমবারও দেখা গেছে হাইড্রোলিক হর্ন। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমার থানায় কোন মালিক এখনও হাইড্রোলিক হর্ন জমা দেননি। একই চিত্র যাত্রাবাড়ী ও বনানী থানাতেও। এই এলাকাতেও ট্রাক, বাস মালিকরা কেউ থানায় হর্ন জমা দেননি। যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিসুর রহমান বলেন, আমরা হাইকোর্টের আদেশটি সম্পর্কে জানি। কিন্তু কোন মালিক আমাদের থানায় হর্ন জমা দেননি। আমাদের এলাকার ট্রাফিকের সহকারী কমিশনার (এসি) অভিযান চালিয়ে কিছু হর্ন জব্দ করেছিল। সেগুলো আমাদের থানায় জমা দেয়া হয়েছিল কিছুদিন আগে। তবে কেউ স্বেচ্ছায় হর্ন জমা দিতে আসেনি বলে জানান তিনি। হাইকোর্টের আদেশের পর রাজধানীতে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ অভিযান চালিয়েছে নিয়মিত। পুলিশ বলছে, স্বেচ্ছায় কেউ হাইড্রোলিক হর্ন খুলছে না। অভিযান পরিচালনা করেই বাস, মিনিবাস ও ট্রাক থেকে হাইড্রোলিক হর্ন খুলতে হচ্ছে। ডিএমপির ট্রাফিকের পূর্ব বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মইনুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে আইন মানার চর্চা আশানুরূপ নয়। আপনি-আমি কেউ আশা করতে পারি না, মালিকরা স্বেচ্ছায় হর্ন থানাতে জমা দিয়ে যাবে। তাই আমাদের অভিযান চালিয়েই হাইড্রোলিক হর্ন অপসারণ করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার মোটরযান আইনেই নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও হাইকোর্টের আদেশ রয়েছে। কিন্তু কেউ তা মানছে না। হর্ন জমা দিচ্ছে না। আমরা নিয়মিত হাইড্রোলিক হর্ন অপসারণ করে যাচ্ছি। আগের চেয়ে অনেক কমে আসছে। তবে এখনও পুরোপুরি নির্মূল করতে পারিনি। মহাখালী বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম হাইড্রোলিক হর্ন আমরা এখন আর ব্যবহার করছি না। তারপরও আমি বলব, হাইড্রোলিক হর্ন থানাতে গিয়ে জমা দিতে হবে কেন? আমি আমার গাড়ির হর্ন ভেঙ্গে ফেললে বা ফেলে দিলেই হলো। সেটা নিয়ে থানায় যাওয়ার কী আছে? তিনি বলেন, হাইওয়েতে যেসব পরিবহনে হাইড্রোলিক হর্ন এখনও ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে কিন্তু এই আদেশের বাস্তবায়ন দেখছি না। হাইড্রোলিক হর্নের দোকানদার ও মজুতদারদের বিষয়ে কী হবে? সেগুলো কেন বন্ধ করা হচ্ছে না? এই পরিবহন মালিক নেতা বলেন, আমরাও চাই হাইড্রোলিক হর্ন যেন না থাকে। কিন্তু তার জন্য সবাইকে একই ছাতার নিচে আসতে হবে। রাজধানী ঢাকায় হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের নির্দেশের পর এবার সারাদেশে যানবাহনে ব্যবহৃত এই হর্ন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হিউম্যান রাইটস্ এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে সম্পূরক আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ গত রবিবার এ আদেশ দেন। পুলিশের অভিযানে ১০ হাজার হর্ন জব্দ ॥ রাজধানীতে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অভিযান চালিয়ে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ গত এক বছরে ১০ হাজার হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করেছে। সম্প্রতি ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ‘শব্দদূষণ ও হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে করণীয়’ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এ তথ্য জানান। ডিএমপি কমিশনার বলেন, হাইড্রোলিক হর্নের অননুমোদিত ব্যবহার কমে এলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পরে ঊর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে জব্দ করা হাইড্রোলিক হর্নগুলো ধ্বংস করা হয়। তিনি বলেন, বাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দেদার হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করছে। সাধারণ হর্নের তুলনায় হাইড্রোলিক হর্নে অনেক গুণ বেশি শব্দ হয়। এসব যানবাহন শহর ও মহাসড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় হাইড্রোলিক হর্নের শব্দে ঘুম থেকে মানুষ আঁতকে ওঠে। এই হর্ন রাস্তার পাশে থাকা হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুরুতর শব্দদূষণ ঘটায়। এই হর্নের শব্দ এক কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত শব্দদূষণ করে। হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর পেছনে গাড়িচালকদের অজ্ঞতা, গাড়ির মালিকের নিয়ন্ত্রণহীনতা, যত্রতত্র হর্ন কেনাবেচা, গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান কম হওয়া, শাস্তির পরিমাণ কম হওয়া, সতর্কতামূলক রোড সাইন কম থাকা, প্রশিক্ষণের ঘাটতি ইত্যাদি বিষয় নজরে আনেন ডিএমপি কমিশনার। রাজধানীতে রাতে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের মতো ভারি যানবাহন হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ডিএমপির পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়ার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তবে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ হাইড্রোলিক হর্নের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নগরবাসী, চালক, মালিক, হর্নবিক্রেতা, প্রস্তুতকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করছে ডিএমপি। সাইনবোর্ড কাজে আসছে না ॥ যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধ করতে এবার রাজধানীজুড়ে সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পর রাজধানীর বিভিন্ন অংশে এ ধরনের ছোট ছোট সাইনবোর্ড চোখে পড়েছে। তবে ট্রাফিক বিভাগ বলছে, উচ্চ আদালতের আদেশের পর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কিছুটা জোরদার করা হয়েছে। গত ১৬ আগস্ট থেকেই এ ধরনের সাইনবোর্ড লাগানো শুরু হয়। ‘হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার আইনত দ-নীয়’ শীর্ষক শিরোনাম সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ট্রাফিক-দক্ষিণ) যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, হাইকোর্টের রায়ের পর সচেতনতার বিষয়টি জোরদার করা হয়েছে। এমনিতে ১৬ আগস্ট থেকে সাইনবোর্ড লাগানো শুরু হয়।
×