ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব গোয়েন্দারা

নর্থ সাউথ শিক্ষক সিজার নিখোঁজের ঘটনা রহস্যজনক

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১০ নভেম্বর ২০১৭

নর্থ সাউথ শিক্ষক সিজার নিখোঁজের ঘটনা রহস্যজনক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ব্যক্তিগত জীবন, কর্ম ও গবেষণা সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের কিছুই জানাতেন না নিখোঁজ বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের হাসান সিজার। এসব বিষয় ছাড়াও আর সবই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তবে পারিবারিকভাবে খুবই আন্তরিক ছিলেন। পরিবারের সবার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল দারুণ। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নিয়ে গবেষণা করার কথা জানা গেলেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোন কিছুই কোন সময়ই পরিবারের সদস্যদের জানাননি। এজন্য সিজারের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি খুবই রহস্যের জন্ম দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সিজারের হদিস মেলেনি। তার সন্ধান জানতে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা। গত ৭ নবেম্বর সিজারের পিতা অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোতাহের হোসেন (৬৫) রাজধানীর খিলগাঁও থানায় সিজারের নিখোঁজের বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ওইদিন সকাল সাতটার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন দক্ষিণ বনশ্রীর ২৫ নম্বর সড়কের ১২/৩ নম্বর বাড়ি থেকে কর্মস্থল বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় গুলশানের বারিধারা ক্যাম্পাসের উদ্দেশে বের হয়। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিজারের ছোট বোন তামান্না তাসমিন জনকণ্ঠকে বলেন, ভাইয়া খুবই হাসিখুশী মানুষ। পরিবারের সবার সঙ্গে সব সময়ই মিশত। তাদের পারিবারিক বন্ধন খুবই ভাল। পরিবারের সবাই সবার খোঁজ রাখেন। কে কোথায় যাচ্ছেন, কি করছেন তা জানত সবাই। তবে ভাইয়ার কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবন এবং তার গবেষণার বিষয় সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানতাম না। এখনও জানি না। ভাইয়াও কোন সময় এসব বিষয় নিয়ে পরিবারের সঙ্গে গভীরভাবে কোন কিছুই আলাপ-আলোচনা করেনি। সে যেহেতু বলত না, এজন্য স্বাভাবিক কারণেই আমরাও তা জানার চেষ্টা করতাম না। তবে পরস্পর জানতে পারি, ভাইয়া সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নিয়ে গবেষণা করতেন। সমাজে কি কারণে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটছে, তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করছিলেন। শুনেছি, ভাইয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদবিষয়ক একটি প্রজেক্টেও কাজ করতেন। ইতোপূর্বে কোনদিনই ভাইয়ার বাড়ি থেকে রাগ করে চলে যাওয়া বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এজন্য ভাইয়ার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি খুবই রহস্যজনক মনে হচ্ছে। তিনি আরও জানান, মতিঝিল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি ও ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টার্স করে ভাইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় বছরখানেক ঢাকায় সাংবাদিকতা করেছিলেন। যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স করেন। দেশে ফিরে তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামে দেড় বছরের মতো কাজ করেন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। ৬/৭ মাস আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে শিক্ষকতা করার কারণে বা অন্য কোন বিষয়ে কোন সময়ই সে কোন চাপ অনুভব বা ঝামেলা পোহায়নি। সিজারের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সিজার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব কতটা ভূমিকা রাখছে, সেটিই ছিল পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু। বাংলাদেশে ফিরে সিজার ঢাকার বেসরকারী ইউল্যাব ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষকতা করেন। প্রায় দুই বছর সেখানে কাজ করার পর ৬/৭ মাস আগে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ইসলাম, রাজনীতি এবং জঙ্গীবাদ বিষয়ে সম্প্রতি তিনি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও জার্নালে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর দিল্লীভিত্তিক একটি জার্নালে বিশ্বায়নের ছায়ায় বাংলাদেশে কিভাবে রাজনৈতিক ইসলাম ও উগ্রবাদী সহিংসতা ছড়াচ্ছে সে সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রায় দুই বছর ধরে তিনি ফেসবুকে বিরক্তিকর বার্তা পেয়ে আসছিলেন। সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ সিজার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ইউএনডিপির সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিষয়ক একটি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি সেখানে কাজ করছিলেন। তার এমন কাজের সঙ্গে নিখোঁজের কোন সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত চলছে। সিজারের সন্ধান পেতে জোরালো তৎপরতা চালানো হচ্ছে। নিখোঁজ সিজারের সন্ধান করার আহ্বান জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনসহ বিভিন্ন সংগঠন। বৃহস্পতিবার সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সিজারের নিখোঁজের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সিজারকে উদ্ধারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। নিখোঁজ সিজারের চাচা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মঞ্জুর হোসেন জানান, গত ২৫ অক্টোবর ছাত্র পরিচয়ে একজন সিজারকে খুঁজতে বাসায় এসেছিল। সিজার ওই সময় বাসায় ছিল না। এরপর থেকেই সিজার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। নিজের নিরাপত্তার জন্য বাসায় সিসি ক্যামেরাও স্থাপন করেছিল। খিলগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমান সিজারের পিতার বরাত দিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যক্তিজীবনে ছয় বছর আগে বিয়ে করেছিলেন সিজার। তিন বছর আগে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। তাদের সংসারে পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। এমন ঘটনার পর সিজার আর বিয়ে করেনি। এমনকি বিয়ে করার আগ্রহও দেখায়নি। নিখোঁজ সিজারের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়ায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত তার সন্ধান মেলেনি। তার সন্ধান জানার চেষ্টা চলছে। পুলিশের পাশাপাশি ডিবি পুলিশও কাজ করছে। সিজারের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা অন্যান্য বিষয় যাচাইবাছাই করা হয়েছে। সিজারের বাসা ও আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তাতে সিজারকে সকাল সাতটার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তথ্য ও চিত্র মিলেছে। ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে সিজারের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত তদন্তে সিজারের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া বা জঙ্গীদের দ্বারা হুমকি পাওয়ার কোন তথ্য মেলেনি। এমনকি তার অতীতে নিখোঁজ হওয়া বা নিখোঁজ হওয়ার চেষ্টা করারও কোন রেকর্ড নেই। তার নিখোঁজের ঘটনাটি খুবই রহস্যজনক। সিজারের সর্বশেষ অবস্থান রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ এমরানুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, সিজারের পিতা তাদের কাছে নিখোঁজ ছেলের সন্ধান করার জন্য লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছেন। সে মোতাবেক সিজারের অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। নিখোঁজের দিন সর্বশেষ সিজারের অবস্থান ছিল আগারগাঁওয়ে। এরপর থেকে সিজারের আর কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সিজারের সন্ধান পেতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নিখোঁজ শিক্ষক সিজারকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
×