ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

না ফিরলে দায়িত্বে আবদুল ওয়াহ্্হাব মিঞা

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ছুটি আজ শেষ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১০ নভেম্বর ২০১৭

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ছুটি আজ শেষ

আরাফাত মুন্না ॥ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটি শেষ হচ্ছে আজ শুক্রবার। দুর্নীতি ও অর্থপাচারসহ ১১ অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশের বাইরে অবস্থানরত প্রধান বিচারপতি দায়িত্বে ফিরবেন কি না, তা ঠিক করে বলতে পারছেন না কেউ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি দেশে না ফিরলে আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোঃ আব্দুল ওয়াহ্্হাব মিঞাই দায়িত্ব পালন করবেন। এই দায়িত্ব পালনে নতুন কোন আদেশও প্রয়োজন হবে না। তারা বলেন, প্রজ্ঞাপনেই বলা হয়েছে ১০ নবেম্বর পর্যন্ত বা প্রধান বিচারপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালন করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। তারা বলেন, যদি প্রধান বিচারপতি দেশে ফেরেনও যেহেতু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছে সেহেতু প্রধান বিচারপতির পদে তার প্রশাসনিক ও বিচারিক দায়িত্ব পালন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার দায়িত্ব পালনের অভিপ্রায়ও সমীচীন হবে না। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এক মাসের ছুটিতে যান। এরপর ছুটি আরও ১০ দিন বাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া যান তিনি। বর্তমানে বিচারপতি সিনহা সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন বলেও জানিয়েছে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর তার আয়কর রিটার্নে অসঙ্গতি ও ব্যাংক এ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় বিতর্কের মুখে পড়েন তিনি। এসব বিষয়ে সিনহার পদত্যাগের দাবিও ওঠে বিভিন্ন মহলে। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ছুটিতে গেলেও গত ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সময় লিখিত বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি সিনহা বলেছিলেন, তিনি সুস্থ আছেন। সাময়িক ভাবে যাচ্ছেন। আবার ফিরবেন। প্রধান বিচারপতি বিদেশে যাওয়ার পরদিন ১৪ অক্টোবর সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে বিভ্রান্তিমূলক উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে থাকা ১১ অভিযোগের কথা জানানো হয়। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে এর আগে সুপ্রীমকোর্টের তরফ থেকে কোন ধরনের বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করা হয়নি। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিবৃতিটি দেয়া হলো।’ সুপ্রীমকোর্টের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১ অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপীল বিভাগের বিচারপতিরা। এরপর এ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন এমন পরিস্থতিতে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরা সুদূরপরাহত। পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে থাকা ১১ অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে দুর্নীতি দমন কমিশন। বৃহস্পতিবার এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমি প্রথম দিন (১৪ অক্টোবর) একটি কথা বলেছিলাম, প্রধান বিচারপতি হিসেবে উনার দায়িত্ব পালন করা সুদূরপরাহত। আজকেও বলছি। কারণ আপীল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা যদি উনার সঙ্গে বসতে না চান তাহলে একা একা উনি কীভাবে বিচার করবেন? তাই প্রধান বিচারপতি হিসেবে এজলাসে বসা এবং বিচার করা সুদূরপরাহত।’ প্রধান বিচারপতি না ফিরলে নতুন কোন প্রজ্ঞাপন বা আদেশের প্রয়োজন আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন করে কোন আদেশের প্রয়োজন নেই। কারণ আগের প্রজ্ঞাপনেই সবকিছু পরিষ্কার করে বলা আছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক ও বার কাউন্সিল ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং অপরাপর গুরুতর অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে আপীল বিভাগের পাঁচ বিচারপতিই তার সঙ্গে এজলাসে বসে বিচার কাজ পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ কারণে প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার দায়িত্বে ফিরে আসা ও বিচার কাজে অংশগ্রহণ বাস্তবতার নিরিখে কোনভাবেই সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আইনজীবীদের আন্দোলনের মুখে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অতীতে সাবেক প্রধান বিচারপতি এফকে মুনিমও ওই পদে বহাল থাকলেও প্রধান বিচারপতির কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুপ্রীমকোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ আগস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে ছুটিতে যান। রাষ্ট্রপতি বরাবরে প্রধান বিচারপতির পাঠানো সেই ছুটির আবেদন সাংবাদিকদেরও দেখান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সেখানে বলা ছিল, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এর আগে তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং গত বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্রামের জন্য ৩ অক্টোবর থেকে ১ নবেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিন তিনি ছুটি কাটাতে চান। এর মধ্যে গত ৭ অক্টোবর বিচারপতি সিনহার অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পাওয়ার খবর আসে। আদালতের একটি সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতি ও তার স্ত্রী সুষমা সিনহা তিন বছরের ভিসা পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বড় মেয়ে সূচনা সিনহার কাছে উঠবেন তারা। এরপর বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা রাষ্ট্রপতিকে জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন বিচারপতি সিনহা। আইন সচিব সেদিন জানান, ১৩ অক্টোবরে থেকে ১০ নবেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার ইচ্ছার কথা ওই চিঠিতে রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। চলতি বছর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের এই সংশোধনী এনেছিল বর্তমান সরকার। হাইকোর্ট ওই সংশোধন বাতিলের পর আপীল বিভাগও একই রায় দেন। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সংসদ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে খাটো করেছেন বলে অভিযোগ তুলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সংসদ সদস্যরা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও তোলেন কেউ কেউ। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার আমলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে স্বাগত জানায় বিএনপি। ষোড়শ সংশোধন বাতিলের ওই রায় ‘ভ্রমাত্মক’ বলে প্রতিক্রিয়া এসেছে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের সদস্য এ বি এম খায়রুল হকের কাছ থেকে। সুপ্রীমকোর্ট এই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবেন জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশা প্রকাশ করেছেন, এতে তারা ‘কামিয়াব’ হবেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনী পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়। ওই প্রস্তাব পাসের আগে সংসদে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের এই রায় দিয়েছে। সংসদ ও গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই রায় দেয়ার উদ্দেশ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
×