ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের নাচনে দ্রুত জমে উঠছে বাঙালীর প্রিয় আড্ডা...

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১০ নভেম্বর ২০১৭

শীতের নাচনে দ্রুত জমে উঠছে বাঙালীর প্রিয় আড্ডা...

সমুদ্র হক ॥ ভোরের তেরছা রোদ কুয়াশার আঁচল চিড়ে জলরাশিতে ঝিলিক তুলেছে। সেখানে এক জোড়া সাদা হাঁস সদ্য স্নান সমাপনে উচ্চৈঃকণ্ঠে খোশ খবর দিচ্ছে- শীতের নাচন শুরু হয়েছে। এই নাচনে দ্রুতই জমে উঠছে বাঙালীর প্রিয় আড্ডার পালা। অন্যান্য সময়ের চেয়ে শীতের আড্ডা সবচেয়ে মজার। নগরী ও শহরাঞ্চলের জনসমাগম পয়েন্টগুলোতে সন্ধ্যায় আড্ডা শুরু হয়। আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের পালা বদলের পালা চলে অনেক রাত অবধি। গ্রামে এই আড্ডা দুই দফায়। সকালের মিষ্টি রোদে ও সন্ধ্যায়। শীত নিরারনে খড়কুটা জ্বালিয়ে চারধারে গোল হয়ে বসে উষ্ণতার সঙ্গে আড্ডাও চলে সমান তালে। এই আড্ডাগুলো যেন ব্যক্তি ও পরিবার থেকে সমাজ, দেশ থেকে বিশ্বের তাবত খবরের বিশ্লেষণের অনুষ্ঠান। মানব জীবনের এমন কিছু নেই যা এসব আড্ডায় কোন না কোনভাবে আলোচনায় আসে না। আড্ডায় এর সঙ্গেই যোগ হয় রাজনীতি। ছেলে বুড়ো সকলেই আড্ডার ভক্ত। জেন্ডারের কোন ভেদাভেদ নেই। আড্ডার পালা শুরু হলে তা আর থামতেই চায় না। অমীমাংসিতই থাকে। টিভির সিরিয়ালগুলোর মতো। কখনও বলা হয় আড্ডায় না গেলে পেটের ভাত হজম হয় না। আবার এই আড্ডা থেকেই বের হয়ে আসে অনেক সৃষ্টিশীলতা। লেখালেখির সঙ্গে যারা কোন না কোনভাবে যুক্ত তারা সৃষ্টির অনেক ক্লু ও খোড়াক পেয়ে যায় আড্ডায়। অনেক না বলা কথা অবচেতনে বলা হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স স্টুডেন্ট সেন্টার (টিএসসি) চত্বর ছিল ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সৃষ্টিশীল আড্ডার চারণভূমি। কত কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক শিল্পীর জন্ম হয়েছে এইসব আড্ডায়। আড্ডার সেই চিরন্তন গান গেয়েছেন মান্না দে। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই.....কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই... কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়। কতজনই এলো গেল কতজনই আসবে কফি হাউসটা তবু থেকে যায় ....।’ এই ওয়ালারা পসরা সাজিয়ে বসেছে। আগে তারা মাথায় পণ্যের ডালা নিয়ে রাস্তার ধারে বসত। কখনও ঘুরে ঘুরে ফেরি করত। হাতে বড় ফ্লাস্ক এবং আরেক হাতে ছোট বালতিতে কাপ ও পানি নিয়ে ঘুরে চা বেচত। দিনে দিনে তাদের মান উন্নীত হয়েছে। চৌকোনা বড় বাক্সের মতো ভ্যান গাড়ি বানিয়েছে। কাঁচে ঘেরা থাকে কিছু অংশ। প্যাডেল বসিয়ে চাকাও লাগিয়েছে। একস্থান থেকে আরেক স্থানে নেয়া যায়। বাক্সের সঙ্গে আছে স্টোভ। এই গাড়ির ভেতরে ফুচকা, চটপটি, সিদ্ধবুট, পুড়ি, পেঁয়াজু, কাবারসহ মুখেরোচক খাবারের ব্যবস্থা থাকে। কোন মোড়, পার্কের গেট, শহরের কেন্দ্রস্থলগুলোতে বসে। এরা যে পয়েন্টগুলোকে গাড়ি নিয়ে দাঁড়ায় (বা বসে) সেখানে কাঠের বেঞ্চ প্লাস্টিকের চেয়ার সাজানো থাকে। কাস্টমার এসে একটু আয়েশে বসে ফুচকা চটপটিসহ মুখরোচক খাবার খায়। বসে আড্ডাও দেয়। তরুণ-তরুণীরা স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে। ইন্টারনেট ফেসবুকে প্রবেশও হয় আড্ডাও চলে। এদের কেউ নগরীর ওয়াইফাই জোন এলাকায় বসে। বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় প্রধান ডাকঘরের সামনে কৃষ্ণচূড়া চত্বর, নবাব বাড়ি সড়কে জিলা স্কুলের সামনের রাস্তার ধারে, শহীদ খোকন পার্কের গেটের সামনে কাঠের বাক্সের ভাসমান দোকানিরা অবস্থান নেয়। এই সময়টায় একটু করে শীত পড়ছে। শীতে ছোটদিনের বিকেল তাড়াতাড়ি আসে। এই সময় থেকেই আড্ডার মানুষরা আসে। সন্ধ্যার জমিয়ে ওঠা আড্ডার আসর শীতের রাতে নয়টার পর ফাঁকা হতে থাকে। আড্ডা যতই জমে বেচাকেনাও ততই বাড়ে। আড্ডাকে ঘিরে ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকানিরাও আশপাশেই অবস্থান নেয়। বর্তমানে চায়েরও অনেক রকমফের। লাল চা বলতে বোঝায় ‘র টি’। লেবু চা, আদা চা, গ্রীন টি, দুধ চা, র-কফি, ব্লাক কফি, দুধ দেয়া কফি, তুলসী চা, টি-ব্যাগ, মশলা চা, মরিচ চা... চায়ের যে কত ধরন। ফুচকা চটপটির দোকানের আড্ডার পর শেষের পর্বে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে চলে চা পানের আড্ডা। এরপর আড্ডার রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘরে ফেরা। রেশটুকু রয়ে যায়। এইসব আড্ডা মূলত প্রস্তুতি ছাড়াই। বিষয়বস্তু নির্ধারণ থাকে না।বলা যায় তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও মধ্য বয়সীদের সময় কাটানো। চাকরিজীবী, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী (কখনও রাজনৈতিক নেতাকর্মীও) শরিক হয় আড্ডায়। অনেক পরিবার বাড়ির সদস্যদের নিয়ে ফুচকার দোকানে গিয়ে বসে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়সীরা তাদের বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় সময় কাটায়। ক’জন বলেন- চায়নিজ রেস্তরাঁ, আধুনিক মার্কেট যুক্ত রেস্তরাঁ, আধুনিক রেস্তরাঁয় আড্ডা দেয়া যায়। তবে তা ব্যয়বহুল। এর চেয়ে অনেক কম খরচে ফুচকা চটপটির দোকানগুলোর প্লাস্টিকের চেয়ার বেঞ্চে বসে মুখরোচক নানা খাবারের সঙ্গে আড্ডায় সময় কাটানো অনেকটা সাশ্রয়ী। এই আড্ডাও যেন হয়ে ওঠে মুখরোচক। আড্ডার মধুময়তার ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায়।
×