ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

উত্তর আমেরিকান মুক্তবাণিজ্য চুক্তি

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১০ নভেম্বর ২০১৭

উত্তর আমেরিকান মুক্তবাণিজ্য চুক্তি

উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (North American Free Trade Agreement -NAFTA) ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ম্যাক্সিকোর মধ্যে বলবত হয়েছে। চুক্তির আওতায় এই তিন দেশের মধ্যে প্রায় সকল শিল্প ও কৃষিপণ্য, সেবাসামগ্রী অবাধ শুল্কবিহীনভাবে আমদানি ও রফতানি করার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সঙ্গে সঙ্গে আঁতেল সম্পত্তি সংরক্ষণমূলক কতিপয় বিধান সাপেক্ষে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে বিনিয়োগ করার পথ খুলে দেয়া হয়েছে। এই চুক্তি হওয়ার পর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এর আগে থেকে বলবতকৃত দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রায় সকল বিধান মেক্সিকোর প্রতি প্রযোজ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য ত্রিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলত মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার এবং কানাডার ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে প্রায় সকল পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্যের পথ খুলে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে মূল নাফটা চুক্তির দুটি সম্পূরক অংশ রয়েছে। এর প্রথমটি হলো পরিবেশ এবং দ্বিতীয়টি শ্রমিক সংক্রান্ত এই তিন দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও অনুসরণের ঐকমত্য। মুক্ত বাণিজ্য এলাকার সদস্য দেশসমূহ নিজেদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পণ্যসামগ্রীর আমদানি ও রফতানির ওপর শুল্ক উঠিয়ে বা একই হারে কমিয়ে দেয়। একই সূত্র অনুযায়ী এসব সদস্য দেশ অসদস্য দেশসমূহ থেকে আমদানীয় বা সে সব দেশে রফতানীয় পণ্যসামগ্রীর ওপর শুল্ক আরোপ করে সার্বিকভাবে তাদের সঙ্গে রফতানি ও আমদানি মাত্রা কমিয়ে দেয়। অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে যে, মুক্ত বাণিজ্য বিষয়ক চুক্তির ২টি প্রতিক্রিয়া ঘটে। এক. সদস্য দেশসমূহের মধ্যে চুক্তির বাইরের দেশসমূহের আপেক্ষিকতায় আমদানি ও রফতানি মুক্ত হওয়ার ফলে নতুনতর বাণিজ্য সৃষ্টি হয়। একে বাণিজ্য সৃজন প্রতিক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সদস্য দেশসমূহের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে অসদস্য দেশসমূহের সঙ্গে শুল্কযুক্ত আমদানি ও রফতানির ব্যবস্থা থাকায় ওইসব দেশের সঙ্গে সদস্য দেশসমূহের বাণিজ্যের পরিমাণ কমে যায়। একে বাণিজ্য বিকল্পায়ন প্রতিক্রিয়া বলে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাণিজ্য সৃজন প্রক্রিয়া যদি বাণিজ্য বিকল্পায়ন প্রতিক্রিয়ার চাইতে বেশি হয় তাহলে মুক্ত বাণিজ্য বিষয়ক চুক্তির ফলে সদস্য দেশসমূহের লাভ হয়। বিপরীত দিকে বাণিজ্য সৃজনপ্রসূত আমদানি-রফতানির পরিমাণ যদি বাণিজ্য বিকল্পায়নের পরিমাণের তুলনায় কম হয় তাহলে সদস্য দেশসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন মুক্ত বাণিজ্য এলাকার দেশের বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি ও পরিমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, মুক্ত বাণিজ্য সদস্য দেশসমূহের মধ্যে নিপুণতর উৎপাদনের দিকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে ধাবিত করে। ফলত সদস্য দেশসমূহের উৎপাদন বাড়ে, সেখানকার উৎপাদন ভোগকারী জনগণ অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে পণ্যসামগ্রী পান এবং এভাবে বিস্তৃত উৎপাদনের মূল্যের অপেক্ষাকৃত বড় অংশ শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে বাণিজ্য বিকল্পায়ন প্রতিক্রিয়ায় অসদস্য দেশসমূহ থেকে আনা পণ্যসামগ্রীর দাম অধিকতর শুল্ক আরোপণের ফলে বেড়ে গেলে সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ক্ষেত্রে সদস্য দেশসমূহের উৎপাদন মূল্য ও মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং অসদস্য দেশসমূহের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, নাফটা চুক্তি হওয়ার পর মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানীয় পণ্যসামগ্রীর অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকরণ শুল্কবিহীন হয়েছে এবং তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকোতে রফতানীয় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি পণ্যসামগ্রী শুল্কবিহীন প্রবেশাধিকার লাভ করেছে। ১৯৯৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্র হতে মেক্সিকোতে রফতানীয় কৃষিপণ্য ছাড়া সব ক্ষেত্রে আমদানি-রফতানি শুল্ক উঠিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হতে মেক্সিকোতে রফতানীয় কতিপয় কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে চুক্তিটি বলবত হওয়ার পরবর্তী ৫ বছরে এদের ওপর আরোপনীয় শুল্ক উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে আগে থেকে বলবতকৃত দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্যের আওতায় নাফটা চুক্তি হওয়ার আগেই অধিকাংশ আমদানীয় ও রফতানীয় পণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এসব প্রত্যাহার পরবর্তীকালে নাফটার আওতায় অপরিবর্তিত থাকে। মোটকথা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মাঝে শুল্কবহির্ভূত বাণিজ্যিক সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ এবং নিপুণতার নিরিখে এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিনিয়োগ প্রবাহিত করার লক্ষ্যে এই চুক্তি গৃহীত হয়েছিল। অবশ্য বলা হয়েছিল, রফতানি ও আমদানিকৃত পণ্য এবং স্থানান্তরিত বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট আঁতেল সম্পদ যথা প্রয়োজন তিন দেশেই তাদের আইন অনুযায়ী প্রতিরক্ষিত করবে। সদস্য ৩টি দেশের মধ্যে নাফটা চুক্তির প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কিত দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক মতবিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য বিস্তারিত পদ্ধতি নির্দিষ্টকৃত হয়েছে। এই পদ্ধতিতে ৩ দেশ থেকে মনোনীত আইনজ্ঞ, বিচারক ও বাণিজ্যে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা একটি অভিন্ন প্যানেলভুক্ত হয়ে বাণিজ্য ক্ষেত্রে দেখা দেয়া বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্বে নিয়োজিত। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীমকোর্টের একজন বিচারক নাম সানড্রা ডে ওকনার সুপ্রীমকোর্টে নিযুক্তি পাওয়ার আগে এক সময় এই ত্রিপক্ষীয় বাণিজ্য বিষয়ক মতপার্থক্য বা বিবাদ দূরীকরণের জন্য নির্দিষ্ট প্যানেলভুক্ত ছিলেন। দ্বিপাক্ষিক কিংবা ত্রিপাক্ষিক আলোচনা বা সিদ্ধান্তায়নের পরিবর্তে এরূপ প্যানেল বা সালিশ কমিটি কর্তৃক বিবাদ বা মতানৈক্য দূরীকরণের ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। ১৯৯৪ থেকে এখন পর্যন্ত এই সালিশ কমিটির সামনে বাণিজ্যে অন্তর্ভুক্ত পণ্যসামগ্রীর মূল উৎসারণ বিষয়ে বিবাদ স্থান পেয়েছে। পরিবেশের ক্ষেত্রে আন্তঃদেশ পর্যায়ে গ্রহণীয় যথাযথ পদক্ষেপ শনাক্তকরণের লক্ষ্যে নাফটার আওতায় পরিবেশ বিষয়ক সহযোগিতা কমিশন স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া পরিবহনের ক্ষেত্রে নাফটার আওতায় এই ৩ সদস্য দেশের সংযোগকারী স্থল করিডর স্থাপন ও প্রশাসনের জন্য একটি অবকাঠামোমূলক কর্তৃপক্ষ স্থাপন করা হয়। সড়ক ছাড়াও রেলপথ ও তেল বা গ্যাস সঞ্চালনের পাইপলাইন, ফাইবার অপটিকভিত্তিক যোগাযোগ প্রসারণ ও সহজকীরণের লক্ষ্যে তখন থেকে এ কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত যে আইনটির ভিত্তিতে নাফটা চুক্তি অনুমোদিত হয়েছিল তার সময়সীমা আগামী বছর জুলাই মাসে শেষ হয়ে যাবে। এই সময়সীমা বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র নাফটার সময়কাল বাড়াতে পারে। এই সময়সীমা না বাড়ালে নাফটার অকাল অবসান ঘটবে। এই বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সমকালীন প্রশাসন তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে নাফটায় কতিপয় সংশোধনী আনার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবিত এসব সংশোধন নাফটা এই ২৩ বছর ধরে যেভাবে প্রাকভাষ দেয়া, মুক্ত তথ্য ও প্রক্রিয়া পরিচালনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করে এসেছে তা পরিবর্তন করতে চাচ্ছে । এই তিন দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য সীমিতকরণের জন্য নাফটার এরূপ সংশোধন বা এ না হলে নাফটা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সড়ে আসা উত্তর আমেরিকার নিরাপত্তা সম্পর্কে, সম্পদ পাচার বন্ধ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, সন্ত্রাস দমনে যৌথ কার্যক্রমে এবং মাদক বাণিজ্য ও মধ্য আমেরিকা থেকে অবৈধ অভিবাসীদের এই তিন দেশে আগমন বা বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া বন্ধকরণের সমন্বিত কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, নাফটা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে কৃষিপণ্যের আমদানি-রফতানি প্রবাহ তাৎপর্যমূলকভাবে বাড়িয়েছে। ২০০৮ সালে এক হিসাব অনুযায়ী দেখা গেছে যে, এর আগের বছর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকোতে ৩২১ বিলিয়ন ডলারের চাইতে বেশি মূল্যের পণ্যসামগ্রী রফতানি করেছে। একই বছর কানাডা যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো থেকে ২৪৫.১ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ পণ্যসামগ্রী আমদানি করেছে। মেক্সিকোতে এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বেশ সংখ্যক কোম্পানি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। ১৯৯৪-২০০১ এ মেক্সিকো থেকে তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিপণ্যের রফতানি প্রতিবছর শতকরা ৯.৪ ভাগ হারে এবং এই দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে কৃষিপণ্যের আমদানি বার্ষিক শকতরা ৬.৯ ভাগ হারে বেড়েছে। এই হারে বাড়ার প্রবণতা সমকালেও বিদ্যমান বলে জানা গেছে। দেখা গেছে যে, নাফটার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকোতে মাংসের রফতানি উঁচু হারে রেড়েছে এবং এর সঙ্গে মেক্সিকোর মাথাপিছু আয় বাড়ার ফলে সে দেশে এসব মাংস ভোগের পরিমাণও প্রায় সমহারে বেড়েছে। নাফটার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে মেক্সিকোর বাণিজ্য ১৫ বছরে প্রায় শতকরা ১১৮ ভাগ বেড়েছে এবং মেক্সিকো প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তর আমেরিকার অংশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্য উদারীকরণের লক্ষ্যে গ্যাট (General Agreement on Tariffs and Trade-GATT) চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কর্তৃক চুক্তিটি অনুমোদন না করা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা বলে গ্যাট চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্য মুক্তকরণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এসেছিল। পরবর্তী ধাপে ১৯৯৫ সালে গ্যাটের বিকল্পায়নে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organi“ation-WTO) স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে সমর্থন যুগিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য মুক্তকরণের লক্ষ্যে দফায় দফায় আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠিত হয়। এই বাণিজ্য সংস্থা পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্য মুক্তকরণের সাধারণ লক্ষ্যে আঞ্চলিক ভিত্তিতেও বাণিজ্য মুক্ত করণে সমর্থন জানিয়ে আসছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নাফটা মুক্ত বাণিজ্য এলাকার উদাহরণ হিসেবে গ্যাট ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক অনুসৃত বাণিজ্য নীতির ইতিবাচকতার প্রতিফলন হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবীব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য বিস্তারণে গ্যাটের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে মূলত দুটি ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি সামনে উঠে এসেছে। (১) বাণিজ্য প্রশাসনে আঁতেল সম্পদ (Intellectual property-TEIPs) -এর অবদান রক্ষাকরণের যৌক্তিকতা ও সময় ব্যাপ্তি বিষয়ে বাণিজ্যরত দেশসমূহকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। আঁতেল সম্পদের উদ্ভাবকদিগকে ক্রমাগতভাবে অধিকতর উদ্ভাবনে উৎসাহ দেয়ার সময়সীমা যুক্তিসঙ্গতভাবে স্থির করে উদ্ভাবিত সম্পদের সব দেশে উৎপাদন বা বাণিজ্যের অববায়িত উপকরণ হিসেবে মুক্তকরণ পৃথিবীব্যাপী উৎপাদন বর্ধনে সহায়ক বলে স্বীকৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য প্রবাহে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী কার্যক্রম বাণিজ্য সম্পর্কিত আঁতেল সম্পদ বিষয়ক কার্যক্রম (Trade Related Intellectual Properties) হিসেবে আখ্যায়িত। একই সঙ্গে বিনিয়োগ প্রসারণে রাষ্ট্রীয় সহায়তা যা সংক্ষেপিতভাবে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ কার্যক্রম (Trade Related Investment Measures-TRIMs) রূপে আখ্যায়িত তা যুক্তিসঙ্গতভাবে কমিয়ে বা নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদনকারী দেশ যাতে সংশ্লিষ্ট পণ্য ভর্তুকিতে রফতানি বা আমদানিকারক দেশে ছুড়ে ফেলতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধান। এ দুটি ক্ষেত্রে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মাঝে উৎপাদন বা পণ্য বিশেষে মতভেদ সৃষ্ট হয়েছে। এতদসত্ত্বেও অর্থনীতিবিদরা ঐকমত্য হয়ে বলেছেন যে, নাফটা এই তিন দেশেরই মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদ ও আন্তঃদেশীয় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে (দ্রষ্টব্য: বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কাউন্সিল, Naftas Economic Impact, ১৮-৭-২০১৭)। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের আগে নাফটা চুক্তি সংশোধন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার মতে নাফটার আওতায় মুক্ত বাণিজ্য নীতি অনুসরণ করায় (১) যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনীয় শিল্পপণ্য উদাহরণত মোটরযান অন্য সদস্য দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে; (২) যুক্তরাষ্ট্রে উৎসারিত বিনিয়োগযোগ্য অর্থ সম্পদ মেক্সিকো ও কানাডায় প্রযুক্ত হয়েছে; (৩) যুক্তরাষ্ট্র আপেক্ষিকভাবে কম মূল্যে অসদস্য দেশসমূহ থেকে আমদানীয় একই মানের অথচ নিম্ন মূল্যের পণ্যসামগ্রীর উপযোগ হতে বঞ্চিত হয়েছে; (৪) অপর ২ সদস্য দেশে বিনিয়োগ সঞ্চালিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থানের পরিধি বা সংখ্যা সঙ্কুচিত হয়েছে এবং (৫) বাণিজ্য বিবাদ নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একক বা সার্বভৌমভাবে তার দেশের আইন কিংবা অনুসরণীয় সূত্র প্রয়োগ করতে পারছে না। এ কয়েকটি অপূর্ণাঙ্গতার আলোকে ট্রাম্প প্রশাসন কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে নাফটা নিয়ে নতুন করে আলোচনা এবং আলোচনার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অধিকতর মাত্রায় রক্ষাকরণের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনায় এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিবাচকতা অর্জন না করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র নাফটা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দিয়েছে। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্র নাফটা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসলে তা মেক্সিকো ও কানাডার জন্য অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। এই প্রেক্ষিতে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নাফটা সংশোধন বিষয়ে কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সমকালীন বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট লাইথ হাইজার নিদেনপক্ষে বিদ্যমান নাফটা চুক্তির সঙ্গে একটি ‘সূর্যাস্ত সূত্র’ যোগ করার প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুযায়ী সমঝোতা ও সংশোধন না হলে আগামী ৫ বছরে নাফটা চুক্তির অবসায়নে তিন দেশকে যথার্থ একমত হতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক নাফটা সংশোধন বা নাফটা থেকে বেরিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ বা অধিকাংশ ব্যবসায়ী সমর্থন করছেন না বলে জানা গেছে। আমেরিকান অটোমেটিভ পলিসি কাউন্সিলের মতে নাফটা ৩ সদস্য দেশের মধ্যে শুল্কবিহীন বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদনের স্কেল বাড়িয়েছে প্রতিযোগিতা প্রসারিত করেছে এবং উৎপাদন নিপুণতা সৃষ্টি করেছে। তাই এ থেকে সরে আসলে এসব ক্ষেত্রে অধিকতর অর্জন থেকে যুক্তরাষ্ট্র বঞ্চিত হবে। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী এর ফলে একমাত্র মোটরযান উৎপাদনের ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ হাজার চাকরির অবসান ঘটবে। তারা বলেছেন, প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডা ও মেক্সিকোর ৩.৩ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ বাণিজ্য সম্পাদিত হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রেই ১৪ মিলিয়ন চাকরির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তারা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, গত বছর নাফটা চুক্তির অপর দুই সদস্য কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও সেবা খাতে বাণিজ্যে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১১.৯ বিলিয়ন ডলার। তাদের মতে এই পরিমাণ বাণিজ্যের সবচেয়ে বেশি উপযোগ ভোগকারী যুক্তরাষ্ট্রের ১ লাখ ২৫ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (দ্রষ্টব্য : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ১৬ ও ১৯ আক্টোবর ২০১৭, নিউইয়র্ক টাইমস, ১৮ অক্টোবর ২০১৭)। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক রবাটো আজভেডো বলেছেন, বহুপাক্ষিক সালিশের (যা নাফটার আওতায় প্রচলন করা হয়েছে) অবসায়ন বাণিজ্য ক্ষেত্রে একপক্ষীয় কার্যক্রম চালু করে বাণিজ্য যুদ্ধের জন্ম দিবে (দ্রষ্টব্য : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, অক্টোবর ১৯, ২০১৭)। এসব প্রেক্ষিতে গত ২৩ বছর ধরে নাফটা চুক্তি আমেরিকার এই ৩টি দেশে মুক্ত বাণিজ্যপ্রসূত যে লাভজনকতা দেখিয়ে এসেছিল তা চুক্তিটি রহিত বা সীমিত হলে হারিয়ে যাবে বলে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্ট্র্রিয়া ফিলেন্ড মন্তব্য করেছেন। আমরা এশীয় দেশ থেকে তার সঙ্গে একমত হয়ে বলতে পারি, উত্তর আমেরিকার বাইরেও নাফটার অবসায়ন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য মুক্তকরণের যে প্রচেষ্টা হাতে নেয়া হয়েছে তা বাধাগ্রস্ত করবে, বিশেষত প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন কর্তৃক প্রস্তাবিত অংশীদারিত্বমূলক সমঝোতার প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে যাবে। এই মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এশীয় সফরকালে এ অভিমতই দিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজু আবে ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়েইন। লেখক : সাবেক সচিব ও মন্ত্রী
×