ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ লা ইকরাহা ফিদ্দীন

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১০ নভেম্বর ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ লা ইকরাহা ফিদ্দীন

কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : লা ইক্রাহা ফিদ্দীন- ধর্মে কোন জোরজবরদস্তি নেই (সূরা বাকারা : আয়াত ২৫৬)। আল্লাহর দেয়া দীন বা জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম। আর এই জীবন ব্যবস্থা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ওহী নাযিল করে নবী-রসূলের মাধ্যমে মানব জাতিকে প্রদান করেছেন, যাতে মানুষ শয়তান দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বিপথগামী হতে না পারে, অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে, পৃথিবীতে ফিত্্না-ফাসাদ সৃষ্টি করতে না পারে। নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে আদিকাল থেকে এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল এসেছেন। তাঁরা সবাই শান্তির দুনিয়া গড়বার, শান্তি কায়েম করবার পথ প্রদর্শন করেছেন। পৃথিবীর এমন কোন জনপদ নেই, এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে নবী-রসূল আসেননি। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : এমন কোন জাতি নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি (সূরা ফাতির : আয়াত ২৪)। প্রত্যেক জাতির জন্য আছে একজন রসূল এবং যখন ওদের রসূল এসেছেন তখন ন্যায়বিচারের সঙ্গে ওদের মীমাংসা হয়েছে এবং ওদের প্রতি জুলুম করা হয়নি (সূরা ইউনুস : আয়াত ৪৭)। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি প্রত্যেক রসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করবার জন্য (সূরা ইবরাহীম : আয়াত ৪)। (হে রসূল), আমি আপনার পূর্বে এমন কোন রসূল প্রেরণ করিনি তাঁর কাছে এই ওহী ব্যতীত যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ্্্ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর (সূরা আম্বিয়া : আয়াত ২৫)। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নবী-রসূল যাঁরা এসেছেন তাঁদের কেউ এসেছেন স্বজাতিকে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য, কেউ এসেছেন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষকে সৎপথের দিশা দেয়ার জন্য। সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে তসরিফ আনেন সমগ্র মানব জাতির জন্য, বিশ্বজগতের জন্য। তিনি রহমাতুল্লিল আলামীন-বিশ্বজগতের জন্য রহমত। তিনি রউফুর রহীম- স্নেহশীল পরম দয়ালু, সাইয়েদুল মুরসালিন, খাতামুন্নাবীয়ীন নূরে মুজাস্্সম। তিনিই ইসলামের পরিপূর্ণতা দান করেন। ইসলাম শব্দের ব্যুৎপত্তি সালম থেকে, যার অর্থই শান্তি আর সে শান্তি সামগ্রিক শান্তি যা আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণের দ্বারা অর্জিত হয়। এই শান্তি মানুষের কল্যাণ সাধনে নিহিত, মানুষের ক্ষতি হয় এমন সমস্ত কর্মকান্ড থেকে নিবৃত্ত থাকার মধ্যে নিহিত। তাই তো পারস্পরিক অভিবাদন হচ্ছে আসসালামু আলাইকুম-ওয়া আলায়কুমুস সালাম। জান্নাত হচ্ছে দারুস্্সালাম। আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ, মানবকল্যাণ ও সৎকর্ম যারা করে তারাই মুসলিম-শান্তি স্থাপনকারী। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : হ্যাঁ, যে কেউ আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ (আসলামা) করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয় তার ফল তার রবের নিকট রয়েছে (সূরা বাকারা : আয়াত ১১২)। ইসলামের সঙ্গে জোরজবরদস্তি, বলপ্রয়োগ, নিপীড়ন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রভৃতির কোনই সম্পর্ক নেই। এসবই ইসলামবিরোধী কর্মকা-। কেননা দীন বা ধর্ম নির্ভর করে বিশ্বাস ও আন্তরিক ইচ্ছার ওপর। বলপ্রয়োগ করে কাউকে প্ররোচিত করা বা রাজি করানো ইসলাম সমর্থন করে না। ফিতনা-ফাসাদ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রভৃতি সৃষ্টি করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ইসলামে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এসবের জন্য ইসলামে সুনির্দিষ্ট শাস্তিবিধান রয়েছে, এমনকি মৃত্যুদ-েরও বিধান রয়েছে। কোন নিরীহ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করাকে হারাম ঘোষণা করে ইরশাদ হয়েছে : কেউ একজন মানুষকে হত্যা করল, সে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল; কেউ একজনের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩২)। যারা সন্ত্রাসবাদী তারা ইসলামের দুশমন, তারা শয়তানের অনুচর, তারা পথভ্রষ্ট। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান যুনুরাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর ১২ বছর স্থায়ী খিলাফতকালের শেষার্ধের দিকে ইয়েমেনের আবদুল্লাহ ইব্নে সাবাহ নামের এক ইয়াহুদী ইসলামে অনুপ্রবেশ করে। সে মদীনা মনওয়ারা থেকে দূরবর্তী কুফা, বসরা, ফুস্্তাত প্রভৃতি অঞ্চলে গিয়ে নিজেকে ইসলাম দরদী হিসেবে জাহির করে খলীফা উসমান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে এক শ্রেণীর তরুণকে উদ্বুদ্ধ করে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। তিন হাজারের মতো লোককে সে সংঘবদ্ধ করে। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে হজের নাম করে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মক্কা মুকররমায় না গিয়ে মদীনা মনওয়ারার নিকটবর্তী স্থানে জড়ো হয় রাতের অন্ধকারে এবং মদীনা মনওয়ারায় ঢুকে পড়ে হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর বাসভবনের পেছনের দেয়াল টপকিয়ে গৃহ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তখন ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছিল। হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু সালাত আদায় করে কুরআন মজীদ তিলওয়াত করছিলেন। ঐ অবস্থায় দুষ্কৃতকারীরা তলোয়ার দিয়ে তাকে আঘাত করে। তাদের তিনি বুঝবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তলোয়ারের আঘাত ঠেকানোর জন্য তাঁর বিবি সাহেবা হযরত নায়িলা হাত বাড়িয়ে দিলে তাঁর হাতের কয়েকটি আঙ্গুল কেটে মেঝেতে পড়ে যায়। হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু রক্তাক্ত অবস্থায় কুরআন মজীদের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যান। তাঁর পবিত্র রক্তের ফোঁটায় সূরা বাকারার ১৩৭ নম্বর আয়াতে কারীমার অংশবিশেষ রক্তে লাল হয়ে যায়। রক্তে লাল হয়ে যাওয়া অংশটি হচ্ছে : ফাসায়াক্্ফীকা হুমুল্লাহু ওয়া হুয়াস্্ সামী’উল আলীম- এবং তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহ্্ই যথেষ্ট, আর তিনি সব শোনেন সব জানেন। এই সময় আরও কয়েকজন সেই হামলায় শহীদ হন। সেই রক্তাক্ত কুরআন মজীদ আজও তাসখন্দ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। হযরত উসমান (রাদি.) এর হত্যাকারী সন্ত্রাসীরা জিলহজ মাস বেছে নেয় এ জন্য যে, এই সময় অধিকাংশ সাহাবী হজ করতে মক্কা গমন করেন। হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু শহীদ হন হিজরী ৩৫ সনের ১৮ জিলহজ মুতাবিক ৬৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.)
×