ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফাঁকফোকর খুঁজছে রোহিঙ্গারা ॥ সাগর পথে নজরদারি বৃদ্ধি

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৯ নভেম্বর ২০১৭

ফাঁকফোকর খুঁজছে রোহিঙ্গারা ॥ সাগর পথে নজরদারি বৃদ্ধি

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকার এখন আন্তরিক নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদ সর্বশেষ যে বিবৃতি দিয়েছে এ নিয়ে আপত্তি করেছে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি। মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতির বিপরীতে বুধবার আউং সান সুচির কার্যালয় থেকে এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, প্রত্যাবাসন ইস্যুতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সুচির দফতর থেকে আরও বলা হয়েছে, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিকভাবে এ সঙ্কট সমাধান হতে পারে। অথচ, রাখাইন রাজ্য থেকে এখনও বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা আগমন অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর ইকবাল বুধবার জানিয়েছেন, সকালে উখিয়ার ইনানি মধ্যম নিদানিয়া সৈকত থেকে ৬৮ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে কুতুপালং ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়েছে। নাফনদ ও সমুদ্র পথে নৌ চলাচল বন্ধ থাকায় রোহিঙ্গারা কখনও সাঁতরিয়ে কখনও ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌযান এমনকি ভেলা ভাসিয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়টি যতই বিলম্বিত হবে ততই পরিস্থিতি ভিন্ন আদলে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার পর রোহিঙ্গাদের যে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলছে তাতে এ পর্যন্ত ৫ লক্ষাধিককে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনে আনা হয়েছে। এ কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। কিন্তু নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত বিষয়টি সরকারী হিসেবের জন্য একটি বড় বিষয় হলেও এতে রোহিঙ্গাদের কিছু যায় আসে না বলেই প্রতীয়মান। অপরদিকে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারের পাশাপাশি রেজিস্টার্ড, আনরেজিস্টার্ড এমন ৭১টি এনজিও সংস্থা কাজ করছে। এনজিওদের মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ৭২টি স্কুলে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমও চলছে। সরকার এসব শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে মিয়ানমারের ভাষা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু এরপরও এদেশের মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাবার সুবাদে ওরা বাংলা ভাষাও শিখছে। যা ভবিষ্যতে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশী এনজিও কর্মীর আধিক্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রীতিমত ভর্তি হয়ে আছে। ৫ বিদেশী আটক হয়ে ছাড় পাওয়ার পর বুধবার ৫টার পর উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ফ্রান্সের দুই নাগরিককে আটক করা হয়েছে। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান জানিয়েছেন, এই দুই বিদেশী প্রয়োজনীয় কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। এছাড়া বিকেল ৫টার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বহিরাগতদের গমনাগমনে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। সে কারণে এই দুই বিদেশীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে থানায় নেয়া হয়েছে। টেকনাফ উখিয়ার আশ্রিত ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা নারীদের পাসপোর্ট করিয়ে বিদেশে পৌঁছে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এক শ্রেণীর দালাল ও আরএসও ক্যাডাররা। যেসব রোহিঙ্গার নিকটাত্মীয়রা বিদেশে অবস্থান করছে, বিশেষ করে তাদের প্রস্তাবে রোহিঙ্গা ক্যাডাররা এক শ্রেণীর দালালের মাধ্যমে ওই মহিলাদের বিদেশে পাঠানোর জন্য অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ধরা পড়ার ভয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রোহিঙ্গা নারীদের পাসপোর্ট করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ওই দালাল চক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও উগ্র মগ সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে তাদের বাসস্থান, স্যানিটেশন, রেশন সামগ্রী ও বায়োমেট্রিক নিবন্ধনসহ সকল ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তারপরও রোহিঙ্গাদের তৎপরতা ইতিবাচক নয়। তারা কৌশলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিদেশে পাড়ি জমাতে তৎপর রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করে থাকে এদেশে ঘাপটি মেরে থাকা আরএসও ক্যাডারদের। তাদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে এক শ্রেণীর দালালের সাহায্যে ওই রোহিঙ্গা নারীদের বিদেশে পাঠানোর অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত মঙ্গলবার কক্সবাজারে ভুয়া পিতাসহ এক রোহিঙ্গা নারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাসপোর্ট করানোর জন্য আসা অপর দুই রোহিঙ্গা মহিলাকে আটক করে পুলিশ। আটক মহিলার বাবা সেজে পাসপোর্ট করতে সহায়তা করার দায়ে শ্রীঘরে ঠাঁই হয়েছে স্থানীয় এক বয়স্ক ব্যক্তির। কথিত মেয়ে রোজিনাকেও তার সঙ্গে আটক করা হয়েছে। কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আবু নাঈম মাসুম এদের পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নোমান হোসেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদ- প্রদান করেন। মোবাইল সিম বিক্রি করায় পাঁচ রোহিঙ্গার জেল ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছে দেশী অপারেটরের সিমকার্ড বিক্রির অভিযোগে ৫ রোহিঙ্গাকে ছয়মাস করে কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। মঙ্গলবার রাতে উখিয়ার কুতুপালং বাজারে অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় বাংলাদেশী অপারেটরের সিম বিক্রির সময় তিনজন পুরনো এবং দুইজন নতুন আসা রোহিঙ্গাকে আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের কোম্পানি কমান্ডার মেজর রহুল আমিন। ভেলাযোগে এসেছে ৫২ রোহিঙ্গা ॥ নৌকা, ট্রলার, জারিকেন ও ভেলা ভাসিয়ে এখনও রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। নাফনদী পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে আরও ৫২ রোহিঙ্গা। বুধবার সকাল ৯টার দিকে একটি ভেলায় চড়ে নাফনদী পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে তারা। তাদের মধ্যে ২২টি শিশু, ১৭ নারী ও ১৩ জন পুরুষ রয়েছে। ভেলায় ভেসে আসা রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করে হেফাজতে রেখেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ভেলার সাহায্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের বুচিদং শহরের চিংঅং গ্রামের বাসিন্দা নুরুল কবির বলেন, মিয়ানমার থেকে পালানোর জন্য নৌকা না পেয়ে গত চার দিন ধরে প্লাস্টিকের জারিকেন ও বাঁশ দিয়ে একটি ভেলা তৈরি করা হয়। পরে ওই ভেলায় ৫২ জনকে নিয়ে মিয়ানমারের মংডু শহরের দংখালি গ্রাম থেকে রাত ৩টার দিকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয় তারা। বইঠা চালিয়ে নাফনদী পাড়ি দিয়ে বুধবার সকাল ৮টার দিকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ায় পৌঁছলে বিজিবি তাদের উদ্ধার করে। বিজিবি-২ এর অধিনায়ক এসএম আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, খবর পেয়ে ৫২ জনকে উদ্ধার ও তাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে রাখা হয়েছে। এইডস রোগী আরও বেড়েছে ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ পর্যন্ত এইচআইভি পজেটিভ বা এইডস আক্রান্ত ৫৯ রোহিঙ্গা শনাক্ত করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৫৫ জন।
×