ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খুলনায় ৪টি যুদ্ধজাহাজ কমিশনিং অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি

সমুদ্রে সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখতে নৌবাহিনীকে সদা সতর্ক থাকতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:১২, ৯ নভেম্বর ২০১৭

সমুদ্রে সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখতে নৌবাহিনীকে সদা সতর্ক থাকতে হবে

অমল সাহা, খুলনা অফিস ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, দেশে নির্মিত সর্ববৃহৎ যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন টাগ নৌবাহিনীতে সংযোজন হওয়ায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। নৌবাহিনীর এ অগ্রযাত্রায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। তিনি নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও নাবিকদের উদ্দেশে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর প্রায় শূন্য থেকে যে নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা আজ একটি পেশাদার ও বহুমাত্রিক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। আপনারা এক দুঃসাহসিক পেশায় নিয়োজিত। বিশাল সমুদ্র আপনাদের কর্মক্ষেত্র। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সামুদ্রিক সম্পদের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। বুধবার দুপুরে খুলনার নৌ ঘাঁটি বানৌজা তিতুমীরের নেভাল বার্থে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধজাহাজ দুর্গম ও নিশান এবং সাবমেরিন টাগ পশুর ও হালদা নৌবহরে কমিশনিং অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অগ্রযাত্রায় আজ এক স্মরণীয় দিন। নৌবাহিনীতে আজ সংযোজিত হলো বহু প্রতীক্ষিত অত্যাধুনিক জাহাজ ‘দুর্গম’ ও ‘নিশান’ এবং সাবমেরিন টাগ ‘হালদা’ ও ‘পশুর’। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের এ মাসেই নৌবাহিনীর জন্য সংগৃহীত ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামে দুটি যুদ্ধজাহাজের মাধ্যমেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী ফ্লিটের যাত্রা শুরু হয়। অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে সমুদ্রপথে হানাদার বাহিনীর রসদ সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার লক্ষ্যে পশুল নদীর অভিযান শুরু হয়। এর ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে সে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ সময়ে তিনি মুক্তযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী নৌ সদস্য বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, শহীদ ফরিদ, শহীদ মহিবুল্লাহ, শহীদ আকতার উদ্দিনসহ অন্যান্য শহীদকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে নৌবাহিনীর গুরুত্ব অনুধাবন করে ৬ দফা দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর সদর দফতর প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে তিনি নৌবাহিনীকে ‘নেভাল এনসাইন’ প্রদানের মাধ্যমে একটি আধুনিক ও শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের দৃঢ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সেই মহান নেতার দিক-নির্দেশনা অনুসরণ করে নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য আজ আমরা নিজস্ব শিপইয়ার্ডে যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, জাতির পিতা শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের জন্য তার রূপকল্প বাস্তবায়নে ছিলেন বদ্ধপরিকর। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দ্রুত উন্নয়নে কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। একইভাবে বর্তমান সরকার নৌবাহিনীকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহ এবং বিদ্যমান জাহাজসমূহের অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী আজ মর্যাদাশীল নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিভিন্ন অবদানের জন্য সুপরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বলেন, নৌবাহিনীকে একটি কার্যকর ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জাতির পিতার পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যা ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে নৌবহরে দুটি আধুনিক সাবমেরিন ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুদ্ধজাহাজ, এয়ারক্রাফট ও আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সংযোজন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শক্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটি নব অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এছাড়া গণচীনে আরও দুটি করভেট নির্মাণ কাজ চলছে। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত চট্টগ্রাম ড্রাই ডকে ফ্রিগেট নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে খুলনা শিপইয়ার্ডসহ অন্যান্য শিপইয়ার্ডে দেশীয় প্রযুক্তিতে জাহাজ নির্মাণের মাধ্যমে এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় সম্ভব হবে। রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ত্রৈমাত্রিক নৌবাহিনী গঠনের লক্ষ্যে প্রথম ধাপ ছিল নৌবাহিনীর জন্য আকাশ সীমানা উন্মোচন। বর্তমান সরকারের আমলে ২টি হেলিকপ্টার ও ২টি মেরিটাইম এয়ারক্রাফট নিয়ে গঠিত হয় নেভাল এভিয়েশন। এরই ধারাবাহিকতায় অত্যাধুনিক সমর ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ২টি হেলিকপ্টার এবং মেরিটাইম এয়ারক্রাফট নেভাল এভিয়েশনে যুক্ত হবে। এসব এয়ারক্রাফট সংযোজনের ফলে নৌবাহিনী স্বল্প সময়ে বিশাল সমুদ্র এলাকায় টহল এবং পর্যবেক্ষণে সক্ষমতা অর্জন করবে, যা সমুদ্রসীমা এবং সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, নতুনভাবে চারটি জাহাজের কমিশনিং ও সংযোজন হওয়ায় নৌবাহিনীর দায়িত্বের পরিধিকে আরও সম্প্রসারিত করেছে। এতে সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে চীন ও মালয়েশিয়া কারিগরি সহায়তা দেয়ায় তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। বড় যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে সফল খুলনা শিপইয়ার্ডকেও অভিনন্দন জানান তিনি। এর আগে বেলা ১২টার কিছু পরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ হেলিকপ্টারযোগে খুলনার তিতুমীর নৌ ঘাঁটিতে পৌঁছান। এ সময় নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ এবং কমডোর কমান্ডিং খুলনার কমডোর সামসুল আলম তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। ১২টা ৪৪ মিনিটে রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে নৌবাহিনীর অফিসার ও নাবিকদের সমন্বয়ে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি যুদ্ধজাহাজ বানৌজা দুর্গম ও বানৌজা নিশান এবং টাগবোট বানৌটা হালদা ও বানৌটা পশুর এর অধিনায়কদের হাতে কমিশনিং ফরমান তুলে দেন এবং নৌবাহিনীর রীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে নামফলক উন্মোচন করেন। পরে রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণদান করেন। ভাষণ শেষে রাষ্ট্রপতি নৌবহরে যুক্ত হওয়া বড় যুদ্ধজাহাজে ওঠেন এবং ঘুরে দেখেন। জাহাজে অবস্থানকালে তিনি ভৈরব নদে নৌকমান্ডো দলের প্রতীকী উদ্ধার অভিযান দেখেন। বেলা ২টায় তিনি অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন, মিজানুর রহমান মিজান এমপি, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ, সেনা ও বিমান বাহিনীর প্রধানগণ এবং সরকারের উচ্চ পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, সুধীজন ও মিডিয়া কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত নৌবাহিনীর নৌবহরে যুক্ত হওয়া বৃহৎ যুদ্ধজাহাজ বানৌজা ‘দুর্গম’ ও বানৌজা ‘নিশান’ তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে খুলনা শিপইয়ার্ডে এ দুটি যুদ্ধজাহাজের নির্মাণ কাজের সূচনা করেন। এ দুটি যুদ্ধজাহাজের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৬৪ দশমিক ২ মিটার, প্রস্থ ৯ মিটার ও গভীরতা ৫ দশমিক ২৫ মিটার। ২৫ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলতে সক্ষম জাহাজ দুটিতে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র রয়েছে। এই যুদ্ধ জাহাজ শত্রুপক্ষের সাবমেরিন ও ডুবো জাহাজ শনাক্ত করে তার ওপর আক্রমণ চালাতে সক্ষম। এছাড়া অন্যান্য আধুনিক সমরাস্ত্রের পাশাপাশি প্রতিটি জাহাজে রয়েছে একটি করে উচ্চ গতি সম্পন্ন বোট যার মাধ্যমে সমুদ্রে উদ্ধার তৎপরতা, সন্ত্রাস ও জলদস্যু দমন এবং চোরাচালান বিরোধী নানাবিধ অপারেশন পরিচালনা করা সম্ভব। এছাড়া নৌবহরে যুক্ত হওয়া সাবমেরিন টাগ হালদা ও পশুর এর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৩২ মিটার এবং প্রস্থ ১১ দশমিক ৬ মিটার। এ টাগ দুটি বহির্নোঙ্গরে ও পোতাশ্রয়ে সাবমেরিনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি নৌবাহিনীর অন্যান্য জাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজকে টোয়িং সহযোগিতা প্রদান, পোতাশ্রয়ে ও সমুদ্রে অগ্নিনির্বাপণ এবং উদ্ধারকারী জাহাজ হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
×