ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিতে শনিবারের শকওয়েভ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৯ নভেম্বর ২০১৭

সৌদিতে শনিবারের শকওয়েভ -স্বদেশ রায়

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স সালমান সে দেশে গত শনিবারের রাতে যা ঘটিয়েছেন তা অনেকদিন সে দেশে ‘শনিবারের শকওয়েভ’ হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। এই হাইভোল্টেজ শকে বাস্তবে কেঁপে উঠেছে মিডল ইস্ট, পশ্চিমা বিশ্বও বেশ তীক্ষè দৃষ্টি রাখছে মি. সালমানের এ কাজের দিকে। তিনি দুর্নীতি দমন অথরিটি তৈরি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁর এক কাজিনসহ এমন এগারো জনকে গ্রেফতার করা হলো- তারা সকলে ধনকুবের। ধনকুবের সৌদিতে অনেকেই আছেন, কিন্তু কেন এই এগারো জনকে গ্রেফতার করা হলো তা নিয়ে কোন ব্যাখ্যা এই লেখা যখন লিখছি তখনও পর্যন্ত দেয়া হয়নি। সৌদি মিডিয়া বলছে, এটা রিফর্ম। সৌদি আরবকে দুর্নীতিমুক্ত করে নতুন সৌদি আরব করা হচ্ছে। এর ফলে শুধু আর্থিক দুর্নীতি দূর নয়, দেখা গেছে পরের দিন সকালে সকলেই সময় মতো অফিসে গেছেন, কাজে গেছেন- যা সৌদিতে একদিন আগেও ছিল একটি অসম্ভব বিষয়। পরের দিন সকালে সবাই ঠিকঠাক মতো অফিসে গেছেন। কাজ করছেন। ওই দিন হঠাৎই আরও একটি শকওয়েভ বয়ে গেছে সৌদি আরবের ওপর দিয়ে, আরেক প্রিন্সসহ ১৩ জন মারা গেছেন একটি হেলিকপ্টার ক্রাশে। সৌদি মিডিয়া এটাকে নিতান্তই হেলিকপ্টার ক্রাশ বলছে, তবে পশ্চিমা মিডিয়ার ভাষ্য ভিন্ন। তারা বলছে এটি হত্যা না প্রকৃত দুর্ঘটনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে এই দুটো ঘটনার ভেতর দিয়ে ক্রাউন প্রিন্স সালমানের ক্ষমতা অনেকখানি নিরঙ্কুশ ও বিপন্মুক্ত হলো বলে মনে করছেন অনেকে। ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও বিপন্মুক্ত করে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত সৌদি এই ক্রাউন প্রিন্স আগামী দিনে সৌদি আরবকে কোথায় নিয়ে যাবেন? সৌদি আরব গত কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে নারী স্বাধীনতা ও কিছু কিছু ছোট ছোট গণতান্ত্রিক অধিকার মানুষকে দিচ্ছিল। তাই অনেকে মনে করছেন, পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এই প্রিন্স তাঁর দেশকে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে পারেন। নিকট বিশ্বে এ ধরনের উদাহরণ আছে ভুটানে। ভুটানের বর্তমান রাজা পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি রাজা হওয়ার পরে ধীরে ধীরে সে দেশে মোটামুটি একটি স্বাধীন পার্লামেন্ট গড়ে তুলেছেন এবং রাজতন্ত্রের হাতকে অনেকখানি ছোট করে নিয়ে এসেছেন। সৌদি প্রিন্স ইচ্ছে করলে সেদিকে যেতে পারেন। অন্যদিকে অতীতের ইতিহাসে গেলে এ ঘটনাকে তিনি আওরঙ্গজেবের ঘটনায় পরিণত করতে পারেন। অর্থাৎ নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করে তিনি আবার পূর্বের মতো একজন বাদশাহ হয়ে যেতে পারেন। আওরঙ্গজেব অনেক দূর অতীতের আর ভুটানের রাজা নিকট অতীতের। অন্যদিকে আওরঙ্গজেবের সময় কোন দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সমীকরণ বলে কোন বিষয় ছিল না। ছিল না মানুষের অধিকার, অর্থনৈতিক যুদ্ধ এসব কোন কিছুই। তাই ইচ্ছে থাকলেও সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের আওরঙ্গজেবে ফেরা সম্ভব নয়। আপাতত তিনি কোন্দিকে যাবেন তার একটা ইঙ্গিত গার্ডিয়ানকে দেয়া তাৎক্ষণিক এক মন্তব্যে বলেছেন। প্রিন্স সালমান গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, সৌদি সাম্রাজ্য গত তিরিশ বছর নরমাল ছিল না। এখন একটি সময় এসেছে সৌদি আরবে মডারেট ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা। এর সঙ্গে রয়েছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কনজারভেটিভ মুসলিম নেতারা পশ্চিমাদের দেয়া এই মুক্তোর মালাটা গলায় পরতে বেশ পছন্দ করেন। এমনকি আমাদের দেশের কিছু নেতাও। সেটা হলো মডারেট মুসলিম। আমাদের বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন আমেরিকা বাংলাদেশকে আদর করে ডাকে মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। বাস্তবে সাম্প্রদায়িকতার নোংরা বাতাবরণ থেকে মানুষের বের হওয়া বেশ কষ্টের। ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের দ্বন্দ্বটা সহস্র বছরের পুরনো। শিল্প বিপ্লব, আগ্নেয়াস্ত্রের উন্নতি ও লিডারশিপের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতাকে পশ্চিমা বিশ্ব অতিক্রম করেছে আধুনিক সভ্যতা দিয়ে। তবে তার পরেও তাদের ভেতর সাম্প্রদায়িক একটা মানসিকতা রয়ে গেছে। অন্যদিকে রয়ে গেছে অতীত সভ্যতার কথা বিবেচনা করে একটা হীনম্মন্যতা। তাই মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতা না বলে তারা ওটাকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামের ভেতর ঢোকাতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যের ৭০ হাজার বছরের সভ্যতাকে তারা চৌদ্দ শ’ বছরের ইসলাম দিয়ে ঢেকে দিতে চায় এবং ইসলামকে তারা পুরোপুরি অন্ধকার যুগের একটা কিছু বলতে চায়। যখনই তাদের মনমতো কোন ইসলামিক নেতা আসে ক্ষমতায় তখন তারা মডারেট মুসলিম বা মডারেট ইসলাম দেখতে পায় সেখানে। এখানে প্রিন্স নিজেই মডারেট ইসলাম দেখেছেন। প্রিন্স যে সময়ে পশ্চিমা মিডিয়াকে বলেছেন তিনি সৌদিতে মডারেট ইসলাম কায়েম করবেন তখন একটি বিষয়ে অন্তত নিশ্চিত হওয়া যায়, সৌদি আরবে এই যে পরিবর্তন ঘটছে এই পরিবর্তনে পশ্চিমা বিশ্বের আশীর্বাদ আছে। পশ্চিমা বিশ্বের আশীর্বাদ যে আছে তাও অবশ্য ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়ে গেছে। এই লেখা যখন লিখছি তখনও পর্যন্ত আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা ফরেন মিনিস্টারের পক্ষ থেকে কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসেনি সৌদি আরব সম্পর্কে। তবে তারা জানিয়েছেন যে, ট্রাম্পের সঙ্গে বাদশাহ ও ক্রাউন প্রিন্সের টেলিফোনে কথা হয়েছে। ট্রাম্প তাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন, এ ঘটনার ভেতর দিয়েই প্রমাণিত, সৌদির এ পরিবর্তনে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন পরিপূর্ণভাবে রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্রাউন প্রিন্স সালমান যখন সৌদিতে এভাবে নিজের ক্ষমতা শক্তিশালী করছেন তখন ধরে নেয়া যায়, সেখানে কিছু হলেও গণতান্ত্রিক বিষয়াদি দেখানো হবে। শুধু দুর্নীতি দমন দিয়ে বিষয়টি শেষ হবে না। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের গণতান্ত্রিক আচরণ কিছুটা হলেও সেখানে প্রতিষ্ঠিত করবে। রক্ষণশীল ও খুব বেশি মেধাবী নয় এমন একটি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স কতটুকু পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সমাজ সেখানে প্রতিষ্ঠিত করবেন তা দেখার জন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, যতদূর বলা যায়, ভুটানের পর্যায়ে তিনি যেতে পারবেন না। ভুটান যে খুব শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তা নয়, তবে তার পরেও ভুটানের রাজা পেরেছেন, কারণ দেশটি কোন অর্থনৈতিক প্লেয়ার নয়। তাই তার ওখানে অন্যদের স্টেক খুবই সামান্য। তাকে নিয়ে কেবল চীন ও ভারতের সামরিক করিডর হিসেবে যতটুকু যা চিন্তা তার থেকে বেশি কিছু নয়। অন্যদিকে সৌদি আরব এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক প্লেয়ার। তার জমাকৃত হাইড্রোকার্বন আর জমাকৃত অর্থ নিয়ে এখানে স্টেক নেই এমন কোন দেশ নেই। এই নানান সুতার টানের ভেতর দিয়ে প্রিন্স সালমান কতদূর যেতে পারবেন সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তিনি গার্ডিয়ানকে দেয়া ওই সাক্ষাতকারে আরও বলেছেন, তাঁর জন্য এ মুহূর্তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ টেররিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। ক্রাউন প্রিন্স যে মুহূর্তে টেররিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলছেন, এই সময়ে মিডল ইস্টে টেররিস্টরাও বা কোন্ পথে যাবে তাও পরিষ্কার নয়। কারণ যে সময়ে প্রিন্স মোহাম্মদ সালমান তাঁর ক্ষমতা নিজ হাতে কেন্দ্রীভূত করছেন ওই সময়ে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হারিরি সন্ত্রাসীর হাতে মৃত্যুর ভয়ে তাঁর দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলছেন, তাঁর পিতা রফিক হারিরির মতো তাঁকেও হত্যা করা হতে পারে। হারিরিকে নিয়ে ইরানের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক কোন্ দিকে যাবে, আমেরিকা এখানে কী ভূমিকা নেবে, তাও এ মুহূর্তে পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে পরিষ্কার নয় মিডল ইস্টে ট্রাম্পের আমেরিকা ফাস্ট নীতি কীভাবে কাজ করবে। আইএস যে পরাজিত হচ্ছে বা প্রায় পরাজিত হয়ে গেছে, এ সময়ে আমেরিকা যে দেশগুলোকে পিছনে থেকে চালাচ্ছে তাদের ভূমিকাও বা কী হবে, কী হবে সৌদি আরবের ভূমিকা? কুর্দি, সুন্নি, সিয়া- এই তিনের সম্পর্ক মিডল ইস্টে কী হবে তাও এখনও কোন প্রকৃত আকার ধারণ করেনি। সৌদির পরিবর্তন ও এগুলোর আকার ধারণ একে অপরের সঙ্গে জড়িত। এমনও বলা যেতে পারে, কুর্দি, সিয়া ও সুন্নির ক্ষমতায়নে অনেক প্রভাব ফেলবে সৌদির পরিবর্তন- আবার অন্যভাবে বলা যায় সুন্নি, কুর্দি ও সিয়ার ক্ষমতায়নের বিষয়টিও প্রভাব ফেলবে সৌদি আরবের ওপর। অতএব এ জন্যও অপেক্ষা করতে হবে কী আকার ধারণ করে মিডল ইস্ট শেষ অবধি। আবার এর পাশাপাশি মিডল ইস্টে বড় একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তাহলো এক শ্রেণীর হতাশ তরুণ সম্প্রদায়। যারা খেলাফতের স্বপ্ন দেখে এক অস্বাভাবিক যুদ্ধ বা ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েছিল, তারা এখন আইএসের পরাজয়ের পরে হতাশ। এই বিপুল সংখ্যক হতাশ তরুণদের নিয়ে কী করবে সে সম্পর্কে আমেরিকা ও তার মিডল ইস্ট বন্ধুদের স্পষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। এই সময়ে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স কোন পদ্ধতিতে সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করবেন তাও একটি বড় প্রশ্ন? তবে সর্বোপরি বলা যায়, যদি সৌদির এই ক্ষমতার কোন আকস্মিক পরিবর্তন না হয় তাহলে সৌদির সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোতে পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তন আসবে সৌদিতে অন্যদের বিনিয়োগ আবার অন্য দেশে সৌদি আরবের বিনিয়োগ পলিসির। সে পরিবর্তনের আকার যদি বড় হয়, পরিবর্তনের ধাক্কা যদি পাকিস্তানের ওপর বড় আকারে পড়ে তাহলে বাংলাদেশ সৌদির এই পরিবর্তন থেকে সুবিধা পাবে। কমবে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ। আর যদি পাকিস্তানের ওপর এই আঁচড় খুব ছোট হয় তাহলে বাংলাদেশ তেমন কিছু পাবে না এই পরিবর্তন থেকে। সৌদির পরিবর্তন পাকিস্তানের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, আমেরিকা সেখানে কী ভূমিকা রাখবে তাও স্পষ্ট হয়ে যাবে খুব দ্রুত। [email protected]
×