ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদা ভাট্টি

সমঝোতা শব্দের ব্যাখ্যা চাই!!

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৮ নভেম্বর ২০১৭

সমঝোতা শব্দের ব্যাখ্যা চাই!!

আবার সমঝোতা শব্দটি বেশ আলোচনায় আসছে। বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে যে, সরকারকে একটা সমঝোতায় পৌঁছুতেই হবে। কিন্তু কী নিয়ে সমঝোতা, কিসের সমঝোতা সে বিষয়ে কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টি আলোচনায় আসে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার যখন এককভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে, তখন দেশে যে সাংবিধানিক অচালবস্থার সৃষ্টি হয় তা থেকে উত্তোরণের জন্য একটি সমঝোতার কথা সর্বত্র আলোচিত হতে শুরু করে। কিন্তু তারও আগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি নিজের গরজেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় আসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে। এর পেছনে অবশ্য কারণ ছিল। এরশাদ মূলত ক্ষমতা নিয়েছিলেন আরেক স্বৈরাচার জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পরে। ফলে বিএনপি মনে করেছিল যে, আওয়ামী লীগকে এই আন্দোলনে সঙ্গে না পেলে তাদের একার পক্ষে এরশাদ সরকারের পতন ঘটানো কোনভাবেই সম্ভব নয়, সে কারণেই তারা যুগপৎ আন্দোলন করে; কিন্তু তাকে ঠিক সমঝোতা বলা যাবে না। এ কারণে বলা যাবে না যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুটি ভিন্ন ধারার, ভিন্ন চেতনার রাজনৈতিক দল। একটি গণতন্ত্রবিরোধী, একটি গণতন্ত্রপন্থী। একটির কোন রাজনৈতিক ইতিহাস নেই, বরং জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার ভেতর দিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সামরিক ছাউনিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ খরচ করে বিএনপির জন্ম। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় পরিচয় এই দলটি জাতির জনকের এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল, দীর্ঘ রাজনৈতিক ও গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি রাজনৈতিক শক্তি। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা রাজনৈতিকভাবেই অবাস্তব একটি ধারণা। কিন্তু দেশ ক্রমশ এগিয়েছে এবং এদেশের মানুষের রাজনৈতিক স্মৃতি ক্রমশ ফিকে হয়ে যাওয়ার কারণে যে কোন রাজনৈতিক, সাংবিধানিক সঙ্কটে দুই বৃহৎ দলের মধ্যে সমঝোতার প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে। যেমনটি এই মুহূর্তে হচ্ছে। কিন্তু তার আগে কিছু প্রশ্ন তোলা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশে যে সরকারটি গঠিত হয় তারা মূলত বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করে। না হলে যে কোন সূচকেই ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ কেবলই পিছিয়েছে। পেছাতে পেছাতে এমন একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বাংলাদেশকে বিশে^র খ্যাতিমান আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা দেয়া হচ্ছিল। ফলে সেখান থেকে ঘুরিয়ে দেশকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। কিন্তু এর মাঝে যে বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে আলোচনায় তুলেছিল তাহলো যুদ্ধাপরাধের বিচার। সরকারের ওপর দেশ ও বিদেশের যে পরিমাণ চাপ তৈরি করা হয়েছিল বিচার না করার জন্য, তাতে যে কোন সময় সরকার পতন হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এরকম একটি জাতীয় ইস্যুতে কখনও সমঝোতার কথা কেউ তোলেননি। তোলেননি, কারণ বিএনপির রাজনৈতিক ও চেতনাগত সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এদেশের শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর সংশ্লিষ্টতা। তাদের এবং আরও কুখ্যাত রাজাকারকে বেগম জিয়া মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। ফলে তাদের বাঁচাতে এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতে ও ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে যে ভয়ঙ্কর ঘটনা এদেশে ঘটে তা মূলত ছিল দেশবিরোধী। তখনও কেউ কেউ দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথা বলেছেন বটে; কিন্তু সেই সমঝোতা আসলে কোন্্ যুক্তিতে, কিসে সে বিষয়ে কখনও কোন স্পষ্ট প্রস্তাব আসেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনে সমঝোতার কথা বলা হয়েছে বটে; কিন্তু সে ব্যবস্থাকে খুন করার পেছনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে কিছুই আর বলার নেই। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ একের পর এক বিপদের ভেতর দিয়ে গিয়েছে, বিশেষ করে জঙ্গীবাদ মোকাবিলায় পশ্চিমা বিশে^র অন্য যে কোন দেশের মতোই বাংলাদেশ একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অতিক্রম করেছে। কিন্তু সেই সময় দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতা তো দূরস্থান, বরং সরকারকে হরেদরে দোষারোপ করা হয়েছে জঙ্গী দমনের নামে তথাকথিত নিরীহ মানুষ হত্যা করার অভিযোগে। যে কোন জঙ্গী-অপারেশনকেই বলা হয়েছে সাজানো নাটক, পরিস্থিতি থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর চেষ্টা ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ এই দুঃসময়ে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ জঙ্গীদের যদি রাজনৈতিকভাবে এভাবে আস্কারা দেয়া হয় তাহলে সরকারের একার পক্ষে তাদের দমন কোনভাবেই সম্ভবপর নয়, একথা বলাই বাহুল্য। হয়েছেও তাই। এদেশ এখনও জঙ্গীবাদের ভয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে ‘সমঝোতা’ নিয়ে সুশীল, অসুশীল, ডান-বাম কোন পক্ষেরই কোন হেলদোল নেই। শুধু সমঝোতা দরকার ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে, তাই তো? দেশে এত বড় একটি বন্যা হলো, শস্য উৎপাদন ভয়ঙ্করভাবে ব্যাহত হলো, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে দেশের অর্থনীতির ওপর তৈরি হলো বিরাট চাপ। কিন্তু সে সময় বন্যা বা ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে শুরু হলো রাজনীতি, যে রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য দুর্বল অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে সরকার পতন। এখানেও সমঝোতার সুযোগ ছিল দুর্গত মানুষের পাশে একত্রিত হয়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তো সমঝোতার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নির্বাচন অনুষ্ঠানে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সমঝোতার প্রয়োজন নেই, কারণ এর মাধ্যমে তো ক্ষমতার রদবদল ঘটবে না! বিষয়টি যারপরনাই দৃষ্টিকটু এবং নোংরাও বটে। বন্যার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিগত আগস্ট মাসে দেশের ওপর নতুন বিপদ হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এসে জুটল। মানবিক কারণে সরকার তাদের আশ্রয় ও অন্ন দিতে বাধ্য হলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসন সকলেই রোহিঙ্গা ইস্যুর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রণয়নের লক্ষ্যে এখনও কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সে সময় বিএনপি নেত্রী গিয়ে বসে থাকলেন লন্ডনে এবং বলে গেলেন যে, ফিরে এসে তিনি একটি সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবেন, যাতে নির্বাচনে তাদের দল জয়লাভ করতে পারে। দীর্ঘ তিন মাস তিনি মৌনব্রত পালন করলেন আর তার দলের নেতারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার কত ব্যর্থ সেই ঢোল বাজাতে থাকলেন। না, এক্ষেত্রে কোন সমঝোতার কথা কেউ বললেন না। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটি যে একটি জাতীয় দুর্যোগে পরিণত হয়েছে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য যে বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে যাচ্ছে এ বিষয়টি কারোরই অজ্ঞাত নয়। তবুও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে রাজনীতিই হলো কেবল, এ বিষয়ে সমঝোতার কথা কেউ তুলল না। কিন্তু আগামী নির্বাচনে রোহিঙ্গা ইস্যুটিও যে তুমুল প্রভাব ফেলবে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। আর সে কারণেই বিএনপি নেত্রী লন্ডন থেকে ফিরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করে গাড়িবহর নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে। যেতে যেতে পথে তিনি অনেক রাজনীতির জন্ম দিয়ে গেলেন, নির্বাচনী প্রচারও চালিয়ে গেলেন, এমনকি শোনা যাচ্ছে তিনি শরণার্থী-দুর্গত এলাকায় কাদের মনোনয়ন দেবেন সেই কাজটিও করে এসেছেন। তার মানে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আসলে রাজনীতির বিষয়, এক্ষেত্রে সমঝোতার কোন ইস্যু নয়, তাই তো? মোটকথা দেশের আর কোন ব্যাপারেই সমঝোতার প্রয়োজন নেই, কেবলমাত্র নির্বাচন, ক্ষমতায় যাওয়া এবং সরকার গঠনের বিষয়েই যখন সুযোগের অভাব ঘটে তখনই সমঝোতার প্রয়োজন পড়ে, তখনই দিকে দিকে ‘সমঝোতা’ শব্দটি নিয়ে মাতম শুরু হয়। বাকি সময়টা দেশটা যদি গোল্লায়ও যায় তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা থাকে না। এখন কেবল বিএনপির পক্ষ থেকেই নয়, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সমিতি কিংবা সুশাসন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ধরনের নাম দিয়ে যারা এদেশে মূলত এই পক্ষটির স্বার্থ সুরক্ষার কাজ করে যান তারাও মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন ‘সমঝোতা’র দোহাই পেড়ে। কিন্তু সমঝোতা কী বিষয়ে, কোথায়, কিভাবে সেসব খোলাসা করছেন না। বোঝাই যাচ্ছে, সমঝোতা শব্দটি এবারও একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দই থেকে যাবে, কোন কাজে আর আসবে না। কারণ এই শব্দের কাজটি কি সেটাই তো এখনও স্পষ্ট নয়! ঢাকা ॥ ৬ নবেম্বর, সোমবার ॥ ২০১৭ ॥ [email protected]
×