স্টাফ রিপোর্টার ॥ নাটকের নিবেদিতপ্রাণ এক মানুষ ব্রাত্য বসু। অভিনয়, নির্দেশনা কিংবা নাট্য রচনা সবকিছুতেই তার সাবলীল বিচরণ। একই ভাবে আপন অভিনয়শৈলীতে রূপালী পর্দায়ও সমান উজ্জ্বল তার উপস্থিতি। নাট্যজনের পাশাপাশি তার আরেক পরিচয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মন্ত্রী। সোমবার বিকেলে এই কীর্তিমান মানুষটির সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা হলো বাংলাদেশের নাট্যজন ও নাট্যকর্মীদের। ওই আলাপচারিতায় উঠে এলো শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতিসহ সমকালীন নানান বিষয়। আড্ডাটি বসেছিল শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে। যৌথভাবে এ আলাপনের আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন।
ব্রাত্য বসুর সঙ্গে প্রাণবন্ত ওই আড্ডায় আলাপচারিতায় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাট্যজন আতাউর রহমান, মামুনুর রশীদ, ড. ইনামুল হক, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, অভিনয়শিল্পী কেরামত মওলাসহ বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের কর্মীবৃন্দ।
আলাপচারিতার একপর্যায়ে ব্রাত্য বসুর কথায় উঠে আসে সারাবিশ্বের ভয়ঙ্কর সঙ্কট সাম্প্রদায়িকতার কথা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িকতা দুই বাংলার জন্যই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা ক্রমাগত বাড়ছে। মৌলবাদ বিষয়টি হিস্টিরিয়ার মতো জড়িয়ে থাকে। আর এ সঙ্কটে সংস্কৃতিকর্মীরা হচ্ছে ‘নৈতিকতার প্রতিনিধি’। মানুষের মাঝে সম্প্রীতি ও নীতিবোধ সৃষ্টিতে কাজ করে যেতে হবে সংস্কৃতিকর্মীদের। সে তিনি মন্ত্রী হোন কিংবা আর অন্য কেউ। তিনি যদি তা না করেন তবে সাংস্কৃতিককর্মীর লক্ষ্য থেকে তিনি বিচ্যুত হবেন।
দুই বাংলার মঞ্চনাটক প্রসঙ্গে ব্রাত্য বসু বলেন, বাংলা নাটক এখন খারাপ সময় কাটাচ্ছে। সারাবিশ্বের মঞ্চনাটকেই এখন ভাটার টান চলছে। যারা এ নিয়ে কাজ করেন তারা প্রত্যেকেই এ নিয়ে চিন্তিত। মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীল চর্চা আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, শুধু থিয়েটার নয়; বিশ্বজুড়েই যারা চিন্তাশীল কাজ করছেন তারা সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন। সেটা ঘটছে শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা থেকে দর্শন প্রতিটি মাধ্যমেই।
রসিকতা করে তিনি বলেন, বর্তমানে সংস্কৃতি দুই ধরনের। একটা শুনলে মাথা দোলে যেমন ক্ল্যাসিকাল মিউজিক। আরেক ধরনের সংস্কৃতি রয়েছে যা শুনলে বা উপভোগ করলে পা দুলে ওঠে। এ অবস্থায় ওই মাথার সংস্কৃতি এখন সারা পৃথিবীতে বিপন্ন।
নাট্যচর্চার বিষয়ে বলেন, থিয়েটার হচ্ছে আমাদের বেঁচে থাকার মাধ্যম। আমাদের কাজ দিয়েই আমাদের পরিচয়। থিয়েটারের সঙ্গে ‘ক্ষণযোগ’ রয়েছে। যা হওয়ার মঞ্চে উপস্থাপনের সময়ই হয়, খানিক পরেই তা মরে যায়। তাই তাৎক্ষণিক উপলব্ধিটা থিয়েটারে খুব বড় বিষয়। প্রকৃতপক্ষে একজন শিল্পীর প্রকৃত জন্মদিন তার মৃত্যুর পর। সমকালে তাকে নিয়ে যে মূল্যায়ন চলে তাতে অনেক রং মিশে থাকে।
ব্রাত্য বসু বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি দমদম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। তার পিতা বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব বিষ্ণু বসু। তার ‘ব্রাত্যজন’ নামে একটি থিয়েটার গ্রুপ রয়েছে। ওই নির্বাচনে তিনি তৎকালীন ক্ষমতাসীন সিপিআই (এম) মন্ত্রী গৌতম দেবকে পরাজিত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন। এর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায় তাকে উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়।
প্রদীপ ঘোষের চিত্র প্রদর্শনী ‘সাঁওতালনামা’
সাঁওতালদের জীবনকে উপজীব্য করে ছবি এঁকেছেন চিত্রকর প্রদীপ ঘোষ। সেসব চিত্রকর্মে উঠে এসেছে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনের সংগ্রাম ও অধিকারের কথা। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকায় সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা এবং হত্যা-নির্যাতনের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সেসব ছবি নিয়ে শুরু হলো প্রদর্শনী। সোমবার সন্ধ্যায় ‘সাঁওতালনামা’ শীর্ষক এ প্রদর্শনীর সূচনা হয় রাজধানীর লালমাটিয়ার বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের চিত্রশালায়। চারুশিল্পী প্রদীপ ঘোষের আরেক পরিচয় তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংসদের চলচ্চিত্র ও চারুকলাবিষয়ক সম্পাদক।
সাঁওতালনামা শিরোনামের এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরেণ্য সাংবাদিক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছেলে প্রকৌশলী মইনুল আবেদিন। উদ্বোধনী আয়োজনে প্রদর্শিত হয় সাঁওতাল হত্যাকা- নিয়ে প্রদীপ ঘোষের গ্রন্থনা, গবেষণা ও পরিকল্পনায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ভূমিহীন ভূমিপুত্র’।
প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে প্রদীপ ঘোষের আঁকা মোট ২১টি চিত্রকর্ম। চিত্রকর্ম সৃজনের আঙ্গিকে সরলতার আশ্রয় নিয়েছেন শিল্পী। সেই সুবাদে দর্শনার্থীদের কাছে বোধগম্য হয়ে ধরা দিয়েছে চিত্রের ভাষা। আগামী ১১ নবেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে এ প্রদর্শনী।
জাদুঘরে জেলহত্যা দিবসের আলোচনা সভা
জেলাহত্যা দিবস উপলক্ষে সোমবার বিকেলে বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি এমপি। আলোচনায় অংশ নেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর মোঃ নজরুল ইসলাম খান। স্বাগত বক্তব্য দেন জাদুঘরের সচিব মোঃ শওকত নবী।
প্রধান অতিথির ভাষণে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি বলেন, দেশপ্রেমকে আশ্রয় করে সবাইকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সততার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে হবে। মানুষে মানুষে সংঘাত বন্ধ করতে হবে। এরপর পঁচাত্তরের সেই অস্থিতিশীল সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, অনেক পরে হলেও স্বাধীনতাবিরোধী এবং বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার হয়েছে। এক সময় সব খুনীর বিচার আমরা পাব আর এজন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা।
সভাপতির বক্তব্যে মোঃ নজরুল ইসলাম খান বলেন, বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ হতে পেরেছেন, কারণ তাঁর সঙ্গে ছিলেন এ চার নেতার মতো বিশ্বস্ত অনুসারী। তিনি আরও বলেন, কিছু ক্ষমতালোভী মানুষের কারণে ১৯৭৫ সালে দেশে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। তাজউদ্দীন আহমদের বিচক্ষণতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালে ভারতের সমর্থন আদায় করতে না পারলে হয়ত আমাদের স্বাধীনতা আরও বিলম্বিত হতো।
এম অহিদুজ্জামান বলেন, সভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাকা-টি ১৯৭৫ সালের তেসরা নবেম্বর রাতের। জেলখানায় ঢুকে ক্ষমতালোভী একদল বর্বর হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। এই চার নেতা শুধু নেতাই ছিলেন না, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। আগামী প্রজন্মের কাছে তাদের অবদান তুলে ধরতে হবে।