ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সব জুয়েলার্সেই চোরাচালানের সোনা ,গডফাদার ৫

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ৬ নভেম্বর ২০১৭

সব জুয়েলার্সেই চোরাচালানের সোনা ,গডফাদার ৫

আজাদ সুলায়মান ॥ শুধু আপন জুয়েলার্স নয়, দেশের শীর্ষস্থানীয় সব জুয়েলার্সেই রয়েছে চোরাচালানের সোনা। চোখ ধাঁধানো দোকানে থরে থরে সাজানো স্বর্ণালঙ্কারের ৯০ ভাগই অবৈধ পথে আনা। হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েই এসব সোনা দেশে আনা হয়। দুবাই, সিঙ্গাপুর,মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী ৫ শীর্ষ গডফাদার ৫ বছর ধরে নিয়মিত এসব সোনার চালান পাঠাচ্ছে। তাদের মধ্যে ৩ জন ঢাকায় গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন কারাগারে কাটিয়ে জামিনে বের হয়েই দেশত্যাগ করেন। এই সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করছে সোনা চোরাচালানের মার্কেট। এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্যই প্রকাশ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা দফতরে একদিনের রিমান্ডে থাকা আপন জুয়েলার্সের মালিক তিন ভাইÑ দিলদার আহমেদ, আজাদ আহমেদ ও গুলজার আহমেদ। জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেছেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তারা তিন ভাই। তাদেরকে বিভিন্ন কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিন ভাই মুখোমুখি যেসব তথ্য দিয়েছেন তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। জানা যায়, রবিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরে আনা হয়। ধর্ষণের মামলায় ছেলে বন্দী হওয়ার ছয় মাস পর ২৪ অক্টোবর দিলদার ও তার দুই ভাই গুলজার আহমেদ ও আজাদ আহমেদকে মুদ্রা পাচার মামলায় কারাগারে পাঠায় ঢাকার আদালত। এ অবস্থায় তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে একদিনের রিমান্ডে আনা হয়। রবিবার শুল্ক গোয়েন্দার উপপরিচালকের টিম দিলদার আহমেদকে, সহকারী পরিচালক হাবিবুর রহমানের টিম আজাদ আহমদ ও ডেপুটি কমিশনার শরিফুল ইসলামের টিম গুলজার আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাতে তাদেরকে রমনা থানায় সোপর্দ করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জনকণ্ঠকে জানায়, এই তিন ভাই আপন জুয়েলার্স থেকে জব্দকৃত সোনা সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী তথ্য দিলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তাদের দোকানের সোনার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তারা জানিয়েছেন- প্রচলিত কায়দায় হাত বদলের পুরনো সোনা সংগ্রহ করা ও ব্যাগেজ-লাগেজ পার্টির কাছ থেকে সোনা কেনা হয়েছে। এর বাইরে অজ্ঞাত বিক্রেতার কাছ থেকেও সংগ্রহ করা হতো সোনা। তাদের এত জুয়েলার্স থাকলেও কখনও বৈধ পথে সোনা আমদানি করা হয়নি। তদন্ত কমিটির এক সদস্য জনকণ্ঠকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তিনভাই বিক্ষুব্ধ হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চানÑদেশে এত সোনার দোকান থাকতে শুধু আপন জুয়েলার্সে কেন এত অভিযান? বাকি জুয়েলার্সেও যদি একই কায়দায় অভিযান চালানো হতো তাহলে এত ক্ষোভের কিছু থাকত না। দেশের সব দোকানে যে উৎস থেকে সোনা আনা বা রাখা হয়; এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে আপন জুয়েলার্স। সোনা সংগ্রহের একই পদ্ধতি ওপেনসিক্রেট। সূত্র আরও জানায়, তাদেরকে কিছু সময় আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করার এক পর্যায়ে মুখোমুখি করা হয়। এ সময় তারা বেশ সংযত ও সতর্কতা বজায় রেখে মাথা নিচু করে বসে থাকেন। তারপরও বার বার তাদেরকে চোরাচালান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে হঠাৎ একভাই ক্ষুব্ধ হয়ে বর্তমান সঙ্কটের জন্য দিলদারকে দায়ী করেন। তার ছেলে সাফায়াতের কুকর্মের খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা পরিবারকে। এমন গুণধর ছেলের লাম্পট্যপনার খেসারত সবাই কেন দেবে এমন প্রশ্নও রাখেন একজন। তদন্ত কমিটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে কারা সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত প্রশ্ন করা হলে তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। কজন গডফাদারের নামও উচ্চারণ করেছেন। তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়,হাতেগোণা ৫/৬ জন। তিন বছর ধরে শুল্ক গোয়েন্দা শাহজালাল ও শাহ আমানত বিমানবন্দরে একের পর এক সাঁড়াশি অভিযানে সোনার সিন্ডিকেট তচনচ করে দেয়ার পর থেকে এসব গডফাদার দেশ ত্যাগ করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় গডফাদার মহম্মদ আলী বর্তমানে দুবাইয়ে। বছর দুয়েক আগে তাকে পল্টনে নিজ বাসা থেকে ৬১ কেজি সোনা ও ৪ কোটি টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়। ওই মামলায় তাকে বেশিদিন জেলে থাকতে হয়নি। কিছুদিন পরই জামিন নিয়ে তিনি দেশ ছাড়েন। এরপরই তার বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা বাংলাদেশের এক যুবক একটি বেসরকারী এয়ারলাইন্সের জিএসএ ব্যবসার আড়ালে মূলত সোনা পাচারের সঙ্গে জড়িত। সিঙ্গাপুর থেকে হজরত শাহ জালাল বিমানবন্দরে আসা সব সোনার প্রকৃত প্রেরক তিনিই। উল্লেখ্য, বনানীতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় গত মে মাসে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদারের ছেলে সাফাত আহমেদ। তার বিচার ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সাফাতের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে তখন দেশজুড়ে তোলপাড়ের মধ্যে আপন জুয়েলার্সের অবৈধ লেনদেনের তদন্তে নামে শুল্ক গোয়েন্দা। এ ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে আসে আপন জুয়েলার্সের অবৈধ সোনার ভা-ার গড়ার কাহিনী। এরপরই একে একে অভিযান চালানো হয় তাদের সব শোরুমে। জব্দ করা হয় সাড়ে ১৪ মণ সোনা। যেখানে মাত্র আড়াই কেজি সোনার বৈধ কাগজপত্র দেখাতে সক্ষম হয় আপন জুয়েলার্স। এতে গত ১২ আগস্ট শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর মুদ্রাপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে দিলদার ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে গুলশান, ধানম-ি, রমনা ও উত্তরা থানায় পাঁচটি মামলা করে। চোরাচালানের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণালঙ্কার এনে এর অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর অন্যান্য জুেয়লার্সে অভিযান আতঙ্ক নেমে আসে। শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রয়োজনে যেখানেই তথ্য পাওয়া যাবে সেখানেই অভিযান চালানো হবে।
×