ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রস্তাব পাস হতে পারে সিপিসিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৬ নভেম্বর ২০১৭

মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রস্তাব পাস হতে পারে সিপিসিতে

সংসদ রিপোর্টার ॥ ঢাকায় কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের ৬৩তম সম্মেলনের (সিপিসি) সাধারণ অধিবেশনে চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সিপিসিতে একটি রেজুলেশন গ্রহণের প্রস্তাব উঠলে সিপিএ চেয়ারপার্সন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বিষয়টি সিপিএর নির্বাহী কমিটিতে তোলা হবে, সেখানে সবার প্রস্তাব অনুযায়ী রেজুলেশনটি যাতে পাস করা যায় সেটা জোরালোভাবে বিবেচনা করা হবে। এছাড়া মিয়ানমারকে চাপ দিতে সিপিএ সদস্য দেশগুলোর পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আহ্বানও জানানো হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। রবিবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইমে সিপিএ সম্মেলনে আসা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। সিপিএ চেয়ারপার্সন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও মহাসচিব আকবর খানের সঞ্চালনায় এ সময় কানাডা, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, মরক্কো, রুয়ান্ডাসহ ১৮টি দেশের প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সিপিসিতে একটি রেজুলেশন আনার প্রস্তাব করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী রোহিঙ্গা ইস্যু সম্পর্কে প্রতিনিধিদের ব্রিফ করেন। সে সময় তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ দেশের সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরার আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে তাদের দেশের সরকারগুলো যেন মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সেই আহ্বানও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, আমরা সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ নিয়েছি। আন্তর্জাতিকভাবেও যেন ভূমিকা রাখা হয় সেটা আমরা প্রত্যাশা করি। আমাদের প্রয়োজন এ ব্যাপারে সবার অব্যাহত সমর্থন। ব্রিফিং-এ আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে কোন বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী। রোহিঙ্গা সঙ্কটটি মিয়ানমারের সৃষ্টি। তাদেরই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের কারণে আজ আমরা সঙ্কটের মুখোমুখি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে আমাদের কঠিন চাপে পড়তে হয়েছে। এ সঙ্কট নিরসনে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাই। তিনি জানান, এরই মধ্যে জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে একটি রেজুলেশন জমা দেয়া আছে। আগামী ১৪ নবেম্বর সেই রেজুলেশনের ওপর ভোট হবে। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দেয়ার জন্য কমনওয়েলথ দেশগুলো প্রতি আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সিপিসি সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে লেবার পার্টির এমপি মার্গারেট কোয়ার্ক রোহিঙ্গা নির্যাতনের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়ে ভারত ও চীনের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চান মাহমুদ আলীর কাছে। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারত এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে এসে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। আর চীন রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠিয়েছে, তবে তাদের ভাষা ভিন্ন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিং শেষে বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধি দলের প্রধান ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া রোহিঙ্গা সমস্যা তুলে ধরেন। এ সময়ে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে চলমান সিপিএ সম্মেলনে একটি রেজুলেশন আকারে গ্রহণ করে সেটিকে নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করলে সিপিএ চেয়ারপার্সন প্রস্তাবটি বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। এরপরে এশিয়া গ্রুপের একটি রিজিওনাল বৈঠকেও ডেপুটি স্পীকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন। এ সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি তাই তাদেরই এর সমাধান করতে হবে। এ সময়ে তিনি রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা দিয়ে নিঃশর্তভাবে তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি চাপ বাড়াতে এশিয়াভুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। এ বৈঠকেও তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুটি রেজুলেশন আকারে গ্রহণ করার প্রস্তাব জানালে সেটি বৈঠকে বিবেচ্য হয়। প্রতিনিধিদের ব্রিফিং শেষে এ সম্পর্কে সিপিসির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বিষয়টি সাংবাদিকদের অবহিত করেন। এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিপিএ সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ব্রিফ করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সিপিএভুক্ত দেশগুলোর সমর্থন চেয়েছেন। নাবিল আহমেদ বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিফিংয়ের সময় বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকে গণহত্যা, জাতিগত নিধন বলে আখ্যা দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের ‘থার্ড কমিটিতে’ একটি আবেদন জমা দেয়া আছে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সমর্থন জানানোর জন্য সিপিএ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি আরও জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিনিধিদের বলেছেন রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের, তাদের কাছেই সমাধান। তাই এজন্য আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে। তাদের মিয়ানমারের ফেরত নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে বিদেশী প্রতিনিধিরা কি জানিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা কথা বলেছেন তারা এক বাক্যেই স্বীকার করেছেন যে মিয়ানমারে গণহত্যা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় সিপিএ প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সরকার প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন বলে জানান তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক বলে অস্বীকার করলেও রোহিঙ্গারা যে সেখানে সংসদ সদস্য ছিল তার তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছেন তিনি। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ৫ দফা প্রস্তাবের আলোকে তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে সিপিএ প্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি আরও বলেন, প্রতিনিধিদের সকলেই এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা রাখাইনে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেয়া পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বলে তিনি জানান। যেভাবে রেজুলেশন আনা হতে পারে ॥ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী যে কোন দেশের প্রতিনিধিরা প্রস্তাবটি আনলে সিপিএর নির্বাহী কমিটির সভায় আলোচনার মাধ্যমে তা গৃহীত হবে। প্রস্তাব আসলে সোম বা মঙ্গলবার সিপিএ সাধারণ সভায় তা গৃহীত হতে পারে। এদিকে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদলের এক সদস্য রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য সিপিএর একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর প্রস্তাব করেছেন। পরে সে বিষয়ে নাবিল আহমেদ জানান, আমাদের সংসদ সচিবালয় নিশ্চয়ই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে এর একটা ব্যবস্থা করবেন। সিপিএর কেউ কক্সবাজারে যেতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিংকালে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, পঙ্কজ দেবনাথ, তানভীর ইমাম, ফজিলাতুন নেছা বাপ্পী প্রমুখ। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেন ॥ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্যরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে তাদের জোরাল অবস্থান তুলে ধরেন। মালদ্বীপের স্পীকার আব্দুল্লাহ মাসেহ মোহাম্মদ বলেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এ ধরনের নির্যাতন হচ্ছে, যা জঘন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘন। এটা একটা গণহত্যা। এটা বন্ধ করতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সিপিএ সম্মেলনে আমাদের প্রস্তাব পাস করতে হবে। কানাডার সিনেটর সালমা আতাউল্লাহ বলেন, মিয়ানমারে যা হয়েছে তা, একটা একটি গণহত্যা। আমরা চাচ্ছি, এ সমস্যার সমাধান হোক। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হোক। তিনি বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ব্যাপক প্রশংসা করেন। সাউথ আফ্রিকার ডেপুটি স্পীকার লেসা সেলোনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতি আমরা আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করি। রাখাইনের ঘটনার নিন্দা জানাই। চলমান সঙ্কট নিরসনে মিয়ানমারের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখার জন্য সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। মালয়েশিয়ার সংসদ সদস্য ড. মোঃ হাতা রামলি বলেন, আমরা মিয়ানমারে প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারি। সেখানে আমাদের বার্তা পৌঁছাতে পারি। যাতে তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেন। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করেন। সকল প্রকার নির্যাতন বন্ধ করেন।
×